বড় দুর্ঘটনা ঘটলে কেউ দায় নিতে চায় না

দেশে পরপর তিনটি বিস্ফোরণ এবং প্রাণহানির ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি মোকাবিলায় সাধারণ মানুষের করণীয় কী, এ নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা সুলতানা রাজিয়ার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমাম হোসেন সাঈদ

সুলতানা রাজিয়া
সুলতানা রাজিয়া
প্রশ্ন

প্রথম আলো: মাত্র চার দিনের (৪–৭ মার্চ) মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ভয়াবহ বিস্ফোরণের তিনটি ঘটনা ঘটল। বিশেষ করে ঢাকার দুটি বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে বলা হচ্ছে, জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে। সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবে ঘরে গ্যাস জমে বিস্ফোরণের মতো ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে?

সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া: ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর ঢাকা শহরে তিন হাজারের বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এর অর্থ হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় ১০টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে রাজধানীতে। এসব অগ্নিকাণ্ডের কোনোটিতে জ্বালানি গ্যাস, এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) অথবা দাহ্য কেমিক্যাল (রাসায়নিক) যুক্ত হলে আগুন বিস্ফোরণে রূপ নিতে পারে।

বসতবাড়িতে গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা অবশ্য উন্নত বিশ্বেও ঘটে। তবে তারা জনসচেতনতা, নিয়মিত গ্যাস–সংযোগের লাইন পরীক্ষা এবং মেরামতের মাধ্যমে, সেই সঙ্গে নিয়মিত ফায়ার ড্রিলের (অগ্নিনিরাপত্তার মহড়া) আয়োজন করে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমিয়ে এনেছে।

আমাদের দেশে বাসাবাড়ীতে সব সময় গ্যাস–সংযোগের লাইনে গ্যাসের সরবরাহ থাকে না। যে কারণে কেউ কেউ চুলা অন (চালু রাখা) করে রাখেন। এর ফল হচ্ছে চুলায় গ্যাসের সরবরাহ আসার পর রান্নাঘরে গ্যাস জমে যেতে পারে। এ ছাড়া গ্যাসলাইনের রাইজার (গ্যাস সরবরাহের সংযোগস্থল) থেকে প্রায়ই গ্যাস লিকেজ (গ্যাস বের হওয়া) হয়। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে মাটির নিচে গ্যাস পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সুয়ারেজ (পয়োবর্জ্য) লাইনে গ্যাস চলে যেতে পারে। এর যেকোনো একটি কারণে যদি মাঝারি আকারের রান্নাঘরে কয়েক শ গ্রাম জ্বালানি গ্যাস জমা হয়, তাহলে আশপাশের কয়েকটি ঘর ধসে পড়ার মতো বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আগে গ্যাসের সঙ্গে মারক্যাপ্টেন (একধরনের রাসায়নিক) যোগ করা হতো, ফলে গ্যাস লিকেজ হলে গন্ধ পাওয়া যেত। আজকাল গ্যাসে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। আর গ্যাস সরবরাহের লাইনে এ রাসায়নিক এখন কেন যোগ করা হয় না, সেটি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ভালো বলতে পারবে।

গ্যাস ডিটেক্টর (পাইপলাইনে ছিদ্র বা লিকেজ শনাক্তকরণ যন্ত্র) স্থাপন করেও গ্যাসের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়। এ যন্ত্র দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্যাস–সংযোগ লাইনের ত্রুটি শনাক্তের কাজটি নিয়মিতভাবে করা অত্যন্ত জরুরি।

আর বাসাবাড়িতে গ্যাস লিকেজ হয়েছে, এমন সন্দেহ তৈরি হলে দ্রুত রাইজারের চাবি বন্ধ করে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। অত্যন্ত জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে রাইজার বন্ধ করে গ্যাসের কাজ করেন, এমন দক্ষ কোনো মিস্ত্রিকে ডেকে লিকেজ মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে। লিকেজ মেরামত নিশ্চিত হয়েছে কি না, সেটি সাবান–পানি দিয়ে পরীক্ষা করার সুযোগ আছে। যদি লাইনের ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাটি সঠিকভাবে মেরামত করা হয়, তাহলে সাবান–পানি ঢালার পর বুদ্‌বুদ উঠবে না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কারখানায় বড় বিস্ফোরণে প্রাণহানির ঘটনার সঙ্গে দেশের মানুষ পরিচিত। এখন দেখা যাচ্ছে বিপণিবিতানে যেখানে বহু মানুষের যাতায়াত, সেখানেও বিস্ফোরণ ঘটছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ কীভাবে সচেতন হবে, সতর্ক থাকবে।

সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া: রাজধানীতে নতুন ও পুরোনো দুই ধরনের আবাসিক ও অনাবাসিক এলাকায় আমরা অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণ ঘটতে দেখেছি। এ পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে অগ্নিনির্বাপণ ও অগ্নিব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জনসচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অধিকাংশ বহুতল ভরনে অগ্নিনির্বাপণের মহড়া হয় না, অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র থকলেও ববহারকারীর সংখ্যা নগণ্য। প্রায়ই দেখা যায় ফায়ার এক্সিট (জরুরি বহির্গমন পথ) ব্যবস্থা কার্যকর নয়। গৃহসজ্জার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের দাহ্য বস্তুর ব্যবহার হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি মোকাবিলায় মানুষকে সচেতন করার জন্য শুধু সরকারি তৎপরতা যথেষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও জনগণকে সচেতন করতে এগিয়ে আসতে হবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের পর কারখানাটির বিস্ফোরক লাইসেন্স নবায়ন ছিল কি না, সেটি বিস্ফোরক অধিদপ্তর ২৪ ঘণ্টা পরও জানাতে পারেনি।

সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া: বাংলাদেশে কোনো ধরনের কারখানা স্থাপন করতে হলে ১৪ থেকে ২০টি সরকারি সংস্থার কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ যেমন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ—ওয়ান–স্টপ সার্ভিস চালু করেছে, যেখানে বিনিয়োগকারীরা এক জায়গায় সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিচ্ছেন এবং সেখান থেকেই সব প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র গ্রহণ করছেন। সব তথ্য অনলাইনে সংরক্ষিত হচ্ছে এবং ট্র্যাকিং (খুঁজে পাওয়া) সম্ভব হচ্ছে। এই চার কর্তৃপক্ষের বাইরেও সব বিনিয়োগকারীর জন্য ওয়ান–স্টপ সার্ভিস চালু করলে তথ্য প্রদান এবং ছাড়পত্রের বিষয়গুলোতে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: পুরান ঢাকার নিমতলীতে ২০১০ সালের জুনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিক গুদাম সরানো নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। কিন্তু এক যুগ পরও বাস্তবতা হচ্ছে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরেনি। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনের পর এ নিয়ে আবার শোরগোল হলো। সরকার রাসায়নিক পল্লি করতে জায়গাও ঠিক করল, প্রকল্প নিল কিন্তু কাজটি এত বছরেও শেষ করতে পারল না কেন?

সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া: এ প্রশ্ন আমারও। এই দীর্ঘসূত্রতা থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে রাসায়নিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের বিষয়টি জাতীয়ভাবে প্রায়োরিটি লিস্টে (অগ্রাধিকার তালিকা) নেই। আমরা রানা প্লাজার ঘটনার পর তৈরি পোশাক খাতে নিরাপত্তাবিধানের জন্য শ্রম আইনে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তা—উভয়ের মধ্যেই তোড়জোড় দেখেছি। ফলে পোশাক খাতে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকটা কমে এসেছে। রাসায়নিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর (যেমন: বিস্ফোরক অধিদপ্তর, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন)  পাশাপাশি এ খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয় ও উদ্যোগের যথেষ্ট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের ঝুঁকি যে শুধু কারখানা বা শিল্প খাতেই বেশি, বিষয়টি এখন আর এমন নয়। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকি কেমন হওয়া দরকার। পাশাপাশি জনবসতির মধ্যে কারখানা বা দাহ্য পদার্থের ব্যবসা বা গুদাম স্থাপনের সুযোগ করে দিয়ে আশপাশের এলাকা কি নিরাপদ করা সম্ভব?

সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া: রাসায়নিকের গুদাম বা কারখানা আশপাশের জনবসতি থেকে নিরাপদ দূরত্বে স্থাপন করার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া রাসায়নিকের ব্যবস্থাপনা এবং এ ধরনের কারখানা পরিচালনার সময় এখন অনেক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়, যা আমাদের দেশের বিধিমালায় নেই। বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষ আংশিকভাবে রাসায়নিক নিরাপত্তার বিষয়টি দেখাশোনা করে, ফলে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কেউ এর দায়ভার নিতে চায় না। এটি রাসায়নিকের আগুনের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, অন্য বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

এখানে একটা বিষয় বলতে চাই, রাসায়নিকের কারণে অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ হলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই রাসায়নিক দুর্ঘটনা এড়াতে এবং এ খাতে শৃঙ্খলা ও সঠিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দেশে একটি জাতীয় রাসায়নিক কমিটি গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। যেটি সব সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বয় ঘটানোর পাশাপাশি নিরাপদ রাসায়নিক ব্যৱস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা তৈরি করবে। এ বিধিমালার আওতায় সংশ্লিষ্ট সব বিনিয়োগকারীকে নিবন্ধন করতে হবে। ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিকের তালিকা, পরিমাণ এবং অবস্থানের একটি সমন্বিত তথ্যভান্ডার তৈরি হবে, যা ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, জরুরি ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি রাসায়নিক সম্পর্কিত নিরাপত্তাবিধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বড় কোনো দুর্ঘটনার পরই সরকারি সংস্থার তদারকিতে ঘাটতি, অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতার বিষয়টি সামনে আসে। এ অবস্থা কি বছরের পর বছর চলতে থাকবে?

সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া: সরকারি সংস্থাগুলোতে দক্ষ ও প্রয়োজনীয় জনবল এবং সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা ও ঘাটতি দেখা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে ঘাটতি থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই না। আবার কোনো একটি দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা দায়ী ব্যক্তি খুঁজে শাস্তি দেওয়ার জন্য বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি কিন্তু দুর্ঘটনার মূল কারণ খুঁজে বের করে তা সমাধানের চেষ্টা করি না। ফলে একই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটতেই থাকে।