সমাজে মেয়েদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। মেয়েদের শুধু ভুক্তভোগী হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে দেখতে হবে। ভবিষ্যতের সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে হলে নারীকে নেতৃত্বের স্থানে নিতে হবে। সেই পরিবেশ তৈরিতে নিরাপত্তাহীনতা, বৈষম্য, অপুষ্টি, নির্যাতন, শিশুশ্রম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহের মতো বড় বাধাগুলো দূর করতে হবে। আজ ১১ অক্টোবর শুক্রবার আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এ মত প্রকাশ করেন তরুণী ও কিশোরীরা।
‘ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে কন্যাশিশুর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্ব’ শিরোনামে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বাংলাদেশ এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এতে প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নারী শিক্ষার্থী ও কিশোরীরা দুটি দলে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। তাঁরা সমস্যার পাশাপাশি কীভাবে সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তোলা যায়, সেই উপায়ও তুলে ধরেন।
কিশোরী প্রতিনিধিরা জানায়, মেয়েদের ক্ষেত্রে পরিবার থেকেই বৈষম্য শুরু হয়। একজন মেয়ে সংসারের দায়িত্ব নেবে না, সেই প্রথাগত ভাবনা থেকে অনেক পরিবার থেকে মেয়েশিশুর পড়াশোনায় যত্ন নেওয়া হয় না। পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাকে অজুহাত করে মেয়েকে বাল্যবিবাহ দিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত হতে চান। তাই বৈষম্য দূর করে মেয়েদের ক্ষমতায়িত করতে পরিবার থেকে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যেকোনো ফোরামে নারীর মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা বলেন, নিরাপত্তাহীনতা মেয়েদের চলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নারী নির্যাতন, নিপীড়ন দেশের উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করে নারীকে ক্ষমতায়িত করার পথে এগিয়ে নিতে হবে। নেতৃত্বের স্থানে নারীকে নিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও বেশি গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। মেয়েদের ভুক্তভোগী হিসেবে না দেখে নেতৃত্বের জায়গায় নিয়ে আসতে হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে ইউনিসেফ বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি এমা ব্রিগহাম বলেন, মেয়েরা একটি দেশের হৃৎপিণ্ড। ১৮ বছরের কম বয়সী অর্ধেকসংখ্যক মেয়ের বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বাল্যবিবাহ মানেই কম বয়সে গর্ভধারণ, দায়িত্ব গ্রহণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হওয়া। ৪০ শতাংশ কিশোরী রক্তশূন্যতায় ভুগছে। এ দেশে যেসব মেয়ে সামনে এগোচ্ছে, তাদের অনেক প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিতে হচ্ছে। সমস্যাগুলো সহজ নয়। আর এর সমাধানও সরলরেখায় করা সম্ভব নয়। কিশোরীরা ভবিষ্যতের ভোটার। তাদের মতামতকে খাটো করে দেখা যাবে না। তারা তাদের দাবিগুলো নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। সেই দাবিগুলো নীতিনির্ধারকদের টেবিলে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করবে ইউনিসেফ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়া দলটিতে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উমামা ফাতেমা ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিফা জান্নাত। এই দলে আরও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমা চাকমা ও রাফিয়া রেহনুমা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামেলিয়া শারমিন চূড়া, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারিহা হোসেন, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজিয়া সুলতানা এবং সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেঘা খেতান।
স্কুল ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়া কিশোরী দলে ছিল এসসি প্ল্যান বাংলাদেশ স্কুলের মিম আক্তার, বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের কাজী আশরাফি আন্নি, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইশাল খান, মিরপুর বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের সানজিদা আক্তার, বিএএফ শাহীন কলেজের ফারাবী জামান, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ফারিয়া সুলতানা ও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের জুনাইরা ইসলাম নুবা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাফিয়া রেহনুমা বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ অনেক জায়গায় নারীর প্রতিনিধিত্বকে সীমাবদ্ধ করে। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে। একজন মেয়ে কী পোশাক পরবে, কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেবে, সেই স্বাধীনতা থাকতে হবে।
বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ভাগ্য নির্ধারণ করে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে নারীর জন্য আরও বেশি গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই পরিবর্তনগুলো আনতে হবে।
বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নাজিফা জান্নাত বলেন, সমাজে নারীর প্রতি কী ধরনের বৈষম্য রয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে কীভাবে দাঁড়াতে হয়, তা শিখিয়েছিল ইউনিসেফের মীনা কার্টুন। বিনোদনের মাধ্যমে বৈষম্যের বিরুদ্ধে চর্চা করা যায়, শিক্ষা নেওয়া যায়, এ ধরনের আরও অনুষ্ঠান প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লাবণ্য প্রজ্ঞা।