‘সবুজ জলবায়ু তহবিলে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশের অভিগম্যতা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত আলোচকেরা। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে
‘সবুজ জলবায়ু তহবিলে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশের অভিগম্যতা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত আলোচকেরা। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে

জাতিসংঘের জলবায়ু তহবিল অন্যায্যভাবে পরিচালিত হচ্ছে, বাড়াচ্ছে ঋণের বোঝা

জাতিসংঘের সবুজ জলবায়ু তহবিল (জিসিএফ) তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য তৈরি করা ওই তহবিল অন্যায্যভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তারা নিজেরাই নিজেদের তৈরি করা নিয়ম ভঙ্গ করছে। সংস্থাটি দুর্নীতির কথা বলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে অর্থ ছাড় করা থেকে বিরত থাকছে। কিন্তু তারা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ‘সবুজ জলবায়ু তহবিলে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশের অভিগম্যতা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব পর্যবেক্ষণ দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জাতীয় প্রতিষ্ঠানে অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া জিসিএফের মূলনীতি হলেও তা অগ্রাহ্য করে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

সুশাসনের বিভিন্ন মানদণ্ডে ঘাটতি, প্রক্রিয়াগত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে জিসিএফ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অর্থ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘তহবিল পাওয়ার জন্য জিসিএফ শুরু থেকেই এমন শর্ত দিয়ে রেখেছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তহবিল পাওয়া থেকে প্রায় নিষিদ্ধ করার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এই তহবিলের সুফল যাদের পাওয়ার কথা, সেসব ক্ষতিগ্রস্ত দেশের কাছে পর্যাপ্ত এবং প্রত্যাশিত মাত্রায় সহায়তা পৌঁছায়নি। তা ছাড়া নির্ধারিত যে অর্থছাড় প্রক্রিয়া আছে, সেটিও মানছে না জিসিএফ। নির্ধারিত যে সময়ের মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থ হস্তান্তর করার কথা, সেটিও তারা করতে পারছে না।’

জিসিএফের নীতিমালায় অস্পষ্টতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে, উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এর সুযোগে আমরা দেখছি, বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি, আইডিবি, এডিবি ও ইবিআরডির মতো বিত্তবান আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকেই জিসিএফ বেশি অর্থায়ন করছে, যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং তহবিল প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যের পরিপন্থী। সর্বোপরি জিসিএফ ক্রমেই জবাবদিহিহীন হয়ে উঠছে, এমন মন্তব্য করা মোটেও অত্যুক্তি হবে না।’

জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অনুদানের পরিবর্তে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার নীতির সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে জিসিএফ বৈষম্যমূলকভাবে শুধু বেশি সহায়তা দিচ্ছে তা-ই নয়, এর সিংহভাগ দিচ্ছে অনুদান হিসেবে। অথচ উন্নয়নশীল দেশের জাতীয় সংস্থাগুলোকে ঋণ বেশি দেওয়া হচ্ছে। যেখানে হওয়ার কথা ছিল ঠিক উল্টো। এসব আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রত্যক্ষভাবে সংকটাপন্ন দেশগুলোর ওপর জিসিএফ আরও ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। অনুদানভিত্তিক কার্যক্রম থেকে সরে গিয়ে ক্রমেই মুনাফাভিত্তিক কার্যক্রমের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

টিআইবির গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, জিসিএফ তহবিলের শুরু থেকে অভিযোজন ও প্রশমন খাতে সমান বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত আট বছরেও তা অর্জিত হয়নি। প্রশমন (মিটিগেশন) খাতে ৫৬ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অভিযোজনের জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত বছরে ২১৫ থেকে ৩৮৭ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হলেও জিসিএফ মাত্র ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন করেছে।

জিসিএফ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশে বেশি হারে ঋণ দেওয়া হচ্ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এককভাবে জিসিএফের অর্থায়নের ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, অনুমোদিত মোট প্রকল্প অর্থের ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণ দেওয়া হয়েছে। আর ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ অনুদান দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, জলবায়ু তহবিল গ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বা এনডিএ হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে জিসিএফের সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। ফলে যোগ্য প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও সরকারের পছন্দমতো প্রতিষ্ঠানকে এনডিএ হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে অভিযোজন প্রকল্পের জন্য জিসিএফ থেকে ১৪১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার (৩২ শতাংশ) অনুমোদন করা হয়েছে। যেখানে প্রশমন প্রকল্পের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ২৫৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার (৫৮ শতাংশ)। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় মধ্য মেয়াদে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কমপক্ষে ১২ হাজার মিলিয়ন ডলার প্রয়োজনের বিপরীতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে অনুমোদন করেছে মোট ১ হাজার ১৮৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার, যা প্রয়োজনীয় অর্থের ৯ দশমিক ৯ শতাংশ।

এ ছাড়া জিসিএফ রেডিনেসসহ বাংলাদেশের জন্য মোট তহবিল অনুমোদন করেছে ৪৪৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার, যা প্রয়োজনীয় মোট অর্থের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে প্রশমন প্রকল্পে বাংলাদেশ ২৫৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার (৭৬ দশমিক ৯ শতাংশ) অনুমোদন পেলেও অভিযোজনবিষয়ক প্রকল্পে পেয়েছে মাত্র ৭৬ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার (২৩ দশমিক ১ শতাংশ)। এর মধ্যে জিসিএফ বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পগুলোয় ঋণ দিয়েছে ৭৫ শতাংশ এবং অনুদান দিয়েছে ২৫ শতাংশ।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোর জন্য জিসিএফের অর্থছাড়েও বিলম্ব হয়। একটি প্রকল্প অনুমোদনের দীর্ঘ তিন বছর পর প্রথম কিস্তির অর্থছাড় করা হয়েছে। ৯টি প্রকল্পে মোট অনুমোদিত অর্থের মাত্র ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ ছাড় করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে টিআইবির উপদেষ্টা ও নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান এবং গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো মো. মাহফুজুল হক। সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসনবিষয়ক রিসার্চ ফেলো নেওয়াজুল মওলা ও রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মো. সহিদুল ইসলাম।

গবেষণার ভিত্তিতে জিসিএফ এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনের জন্য ১৪টি সুপারিশ করেছে টিআইবি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের জিসিএফের অর্থ পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা এবং জলবায়ুঝুঁকিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থ পাওয়া ত্বরান্বিত করতে ক্ষেত্রবিশেষে মানদণ্ডগুলো আরও সহজ করা।