তিনি একজন ‘ভাগ্যবান’ সচিব। বর্তমান সরকারের আমলে তিনি সবচেয়ে বেশি সময়ের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন।
দেশ স্বাধীনের পর গত ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে একটি মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। টানা ছয় বছর তিনি মন্ত্রণালয়টিতে আছেন। তার মধ্যে পাঁচ বছরই চুক্তিভিত্তিক। মন্ত্রণালয়টির শীর্ষ পদে এতটা সময় আর কেউ ছিলেন না।
এই সচিবের নাম শহীদ উল্লা খন্দকার। তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে তিনি আবার আলোচনায়। কারণ, ২২ সেপ্টেম্বর তাঁর সর্বশেষ চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ কি আরেক দফা বাড়ছে, নাকি এবার তিনি বিদায় নিচ্ছেন, তা নিয়ে এখন কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, গণপূর্তসচিব শহীদ উল্লা খন্দকার এখন পর্যন্ত তিনবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন।
২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর চাকরির মেয়াদ শেষে শহীদ উল্লা খন্দকারের অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকার তাঁর পিআরএল বাতিল করে। তাঁকে দুই বছরের চুক্তিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শহীদ উল্লা খন্দকারের চুক্তির মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। ২০২১ সালে তাঁর চুক্তির মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। সে হিসাবে তাঁর সর্বশেষ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ ২২ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়ার কথা।
তিন দফায় শহীদ উল্লা খন্দকারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মোট মেয়াদ দাঁড়িয়েছে পাঁচ বছর। জনপ্রশাসনে সচিব পদে টানা পাঁচ বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ঘটনা বিরল বলে জানা গেছে।
এ কারণে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা শহীদ উল্লা খন্দকারকে তাঁর ব্যাচমেট ও অধস্তন কর্মকর্তারা ‘ভাগ্যবান সচিব’ হিসেবে আখ্যা দেন।
প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ আছে। কারণ, কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলে আরেকজন কর্মকর্তা সচিব হওয়া থেকে বঞ্চিত হন।
শহীদ উল্লা খন্দকারের চুক্তির মেয়াদ আরেক দফা বাড়ছে কি না, তা শিগগির জানা যাবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, জাতিসংঘের সাধারণ সভায় যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র যাবেন। তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে জানা যেতে পারে, গণপূর্তসচিব শহীদ উল্লা খন্দকারের চুক্তির মেয়াদ বাড়ছে কি না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ঘটনা স্বাভাবিক।
বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউস—দুজনই দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন। তাঁদের চুক্তির মেয়াদ চলতি বছর শেষ হচ্ছে।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সচিব এন এম জিয়াউল আলমসহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিব চুক্তিতে আছেন। কিন্তু তাঁদের কেউই টানা পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাননি।
টানা পাঁচ বছর চুক্তিতে আরেকজন আছেন। তিনি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জন বিভাগের সচিব সম্পদ বড়ুয়া। তাঁর চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে। এ মন্ত্রণালয়ের প্রথম সচিব ছিলেন প্রকৌশলী মঈনুল ইসলাম। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫, অর্থাৎ তিন বছর তিনি সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
মন্ত্রণালয়টিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চার বছর ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সচিব ছিলেন খোন্দকার শওকত হোসেন। তবে তাঁকে ছাড়িয়ে চুক্তিভিত্তিকসহ মোট ছয় বছর একই পদে থাকার রেকর্ড গড়েছেন বর্তমান সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার।
মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য বলছে, শহীদ উল্লা খন্দকারের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়ী গ্রামে। তিনি নারিকেলবাড়ী উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং বিএম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ থেকে তিনি স্নাতকোত্তর করেন।
শহীদ উল্লা খন্দকার সহকারী কমিশনার, উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, কগনিজেন্স ম্যাজিস্ট্রেট, নেজারত ডেপুটি কালেক্টর, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর ও থানা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পরবর্তী সময়ে শহীদ উল্লা খন্দকার উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পর্যায়ক্রমে অর্থ মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শহীদ উল্লা খন্দকার ২০১৪ সালে পদোন্নতি পেয়ে ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) যোগ দেন। ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি সচিব হন।
২০১৬ সালে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে যোগ দেন শহীদ উল্লা খন্দকার। একই বছর তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে যোগ দেন। তার পর থেকে তিনি এখন পর্যন্ত একই মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন।
এ বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের মুঠোফোনে গত বুধবার থেকে বেশ কয়েকবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। তাঁর মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, কোনো সচিব যদি কোনো মন্ত্রণালয়ের জন্য অপরিহার্য হন, তাঁকে ছাড়া মন্ত্রণালয়টি চলবেই না, তখনই কেবল কিছু সময়ের জন্য (চুক্তি করে) তাঁকে সেখানে রাখা যেতে পারে। কিন্তু এত লম্বা সময় ধরে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদে কাউকে চুক্তিতে রাখা উচিত নয়। এতে পদটি ব্লক হয়ে যায়। অন্য কর্মকর্তার ওপর অবিচার করা হয়।
আলী ইমাম মজুমদার আরও বলেন, একজনকে যদি বছরের পর বছর চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন অন্য কর্মকর্তা সচিব হওয়া থেকে বঞ্চিত হন। এর প্রভাব পুরো প্রশাসনিক কাঠামোতে পড়ে।