কলাগাছের ভেলায় করে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বন্যাকবলিত কয়েকজনকে। গতকাল বেলা তিনটার দিকে ফেনী সদরের খাইয়ারা বাজার এলাকায়
কলাগাছের ভেলায় করে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বন্যাকবলিত কয়েকজনকে। গতকাল বেলা তিনটার দিকে ফেনী সদরের খাইয়ারা বাজার এলাকায়

ফেনীতে ভয়াবহ বন্যা

আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার–পানির তীব্র সংকট

বন্যায় ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ার পর ফেনী সদরের বোগদাদিয়া এলাকার বাগদাদ কনভেনশন সেন্টারে আশ্রয় নেন নুরুল আবসার। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে তাঁর বাড়ি। পরিবারের আরও ছয় সদস্যের ঠিকানা এখন ওই আশ্রয়কেন্দ্র।

নুরুল আবসার গতকাল শুক্রবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, তিন দিন আগে তাঁদের বাড়িঘর ডুবে যায়। রাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনো রকমে সেন্টারে এসে আশ্রয় নেন। একটি কক্ষে আরও অনেক বন্যাকবলিত মানুষের সঙ্গে থাকছেন। দুদিন ধরে একটি দানাও পেটে পড়েনি। সবার অবস্থা একই।

ঘরবাড়ি হারিয়ে ওই অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে মাথা গুঁজেছেন গোলাপ মিয়া (৫০)। পশ্চিম ছনুয়ায় তাঁর বাড়ি। দুই ছেলে ও স্ত্রী আছেন সঙ্গে। গোলাপ মিয়া জানান, পানি কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছে, ভোগান্তিও বাড়ছে। খাবার নেই, পানি নেই।

বাগদাদ কনভেনশন সেন্টারটি তিনতলা। নিচতলা পানিতে সয়লাব। বাকি তলার আট কক্ষে কয়েক শ মানুষ তিন দিন ধরে থাকছেন।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজী—এ ছয় উপজেলা গতকালও পুরোপুরি বন্যাকবলিত ছিল। সদর ও সোনাগাজী উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ দুর্ভোগে আছেন। এ ছাড়া অন্তত এক লাখ মানুষ পানিবন্দী। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই।

আবার কয়েক লাখ মানুষ স্থানীয় স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। খাবার ও পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। যদিও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শুকনা খাবার বিতরণ করছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ফেনীতে বন্যায় একজনের মৃত্যু হয়েছে।

মূলত ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণের কারণে ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। পাঁচ দিন ধরে মানুষ পানির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।

দুর্বিষহ জীবন

১০ নম্বর ছনুয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বোগদাদিয়া এলাকায় বোগদাদিয়া উচ্চবিদ্যালয় ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র। চারতলার দুটি ভবন নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রটিতে অর্ধশতাধিক কক্ষ। কোনো কক্ষে ৫০ জন, কোনোটিতে ৬০ জন পর্যন্ত থাকছেন। আবার কারও ঠাঁই হয়েছে বারান্দায়। সব মিলিয়ে দেড় হাজারের কম নয়।

গতকাল বেলা ৩টায় কিছুদূর পানি হাতড়ে এবং কিছুদূর নৌকাযোগে দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছান এ প্রতিবেদক। যেতে যেতে মনে হলো, পুরো গ্রাম আস্ত এক নদীতে পরিণত হয়েছে। বয়ে চলেছে অথৈ পানির প্রবাহ।

পরে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দেখা যায়, ভবনের নিচতলা ডুবে আছে। কোনো নৌকা গেলেই গ্রামবাসী ত্রাণের আশায় কক্ষ থেকে বেরিয়ে বারান্দায় চলে আসছিলেন। কাপড়চোপড়, ব্যাগ, হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল নিয়ে দুর্বিষহ সময় পার করছেন বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা। কক্ষগুলোয় অনেকটা নিশ্বাস দূরত্বে মানুষ বসে কিংবা দাঁড়িয়ে আছেন। চারদিকে জীর্ণ পরিবেশ। শৌচাগারেও বন্যার পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। খাবার পানির সংকট আছেই।

খাদিজা বেগমের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বুধবার পরিবারের আরও পাঁচ সদস্য নিয়ে আশ্রয় পেতেছেন তিনি। খাদিজা বেগম জানান, সাত কামরার মাটির ঘর ছিল তাঁদের। বুধবার বাড়িতে হাঁটুসমান পানি ছিল। বৃহস্পতিবার সকালে পুরোপুরি ডুবে যায়। পানি যখন বাড়ছিল, তখন ধীরে ধীরে ঘর ভেঙে পড়েছে। চোখের সামনে ৫০ বছরের পুরোনো বাড়িটি ভেঙে পড়েছে।

খাদিজা বেগমের দুই ছেলে। বড় ছেলে নুর সালাম (৩০) পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। মায়ের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে তিনি বলেন, ‘আরেকটা ঘর তোলার মতো পরিস্থিতি নেই। কোনো জিনিসপত্র বের করতে পারিনি। কয়েকটা কাপড় নিয়ে বের হয়েছি।’

নুর তাঁর অনিশ্চয়তার গল্প তুলে ধরলেন। তিনি বলেন, যে বেতন পান, তা দিয়ে সংসরাই চলে না। এখন আবার নতুন করে সব শুরু করতে হবে। ভাড়া বাসায় উঠতে হবে।

কথা হয় সাবিনা আক্তারের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় জেনে তিনি প্রশ্ন করলেন, কত দিন থাকতে হবে, পানি নামতে লাগবে কত দিন? সাবিনা বলেন, অকল্পনীয় ভোগান্তিতে আছেন তাঁরা। হঠাৎ বন্যায় সব ওলটপালট হয়ে গেছে।

খাইয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও আশ্রয় পেতেছেন কয়েক শ মানুষ। ছোট ছোট কক্ষে দিন-রাত পার করছেন তাঁরা। কল্পনা রানি দাস জানান, মুড়ি, বিস্কুট, চিড়া দিয়ে গেছেন অনেকে। এভাবে কত দিন থাকবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

উদ্ধারে স্বেচ্ছাসেবীরা

ফেনী সদরের বিভিন্ন গ্রামে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করেছে চট্টগ্রাম নগর থেকে যাওয়া একটি দল। তারা দুটি বোটে ৭০ জনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়েছে। এই দলের সদস্য ইভেন মীর প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের পর গ্রাম ডুবে আছে। ভবনের ছাদে আটকা পড়াদের উদ্ধার করা হচ্ছে। অনেককে খাবার দেওয়া হচ্ছে।

ফেনী সদর উপজেলার ফরহাদনগর, মোটবী ও ধর্মপুর ইউনিয়নে উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়েছেন সীতাকুণ্ডের একদল স্বেচ্ছাসেবক। দলের সদস্য নাজমুল ইসলাম জানান, পাঁচটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় অন্তত ২০০ মানুষকে তাঁরা আশ্রয়কেন্দ্র ও মহাসড়কে পৌঁছে দিয়েছেন।

তবে বিস্তীর্ণ এলাকার অনেকেই গতকাল রাত পর্যন্ত আটকে ছিলেন। ১০ নম্বর ছনুয়া ইউনিয়নের উত্তর টংগিরপাড় হাজী বাড়ি মসজিদ এলাকায় এক পরিবারের সাতজন আটকে আছেন। ওই পরিবারের আরেক সদস্য শিক্ষক ফারজানা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, এলাকাটি পুরো ডুবে গেছে। শিশুসহ তাঁর পরিবারের সাতজন আটকে আছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে তাঁদের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না।

ফারজানা আক্তার সর্বশেষ গতকাল সন্ধ্যা সাতটার দিকে তাঁর ভাবি তানিয়া আক্তারের সঙ্গে খুদে বার্তার মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন। খুদে বার্তায় ভাবি জানিয়েছেন, তাঁরা সবাই এলাকার একটি মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন। ভবনের এক তলা ডুবে দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি পর্যন্ত পানি চলে এসেছে। মসজিদে গ্রামের কয়েক শ মানুষ আছেন। পথঘাট ডুবে যাওয়ায় কেউ বের হতে পারছেন না। এরপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

কেউ ২৪ ঘণ্টা, কেউ ৩০ ঘণ্টা পথে

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বুধবার থেকে কার্যত অচল। মিরসরাই থেকে ফেনী সদর পর্যন্ত কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। শুধু ত্রাণবাহী যানবাহন থেমে থেমে চলাচল করছে। সড়কের বিভিন্ন অংশ গতকাল ডুবে ছিল। কোনো যানবাহন ২৪ ঘণ্টা, কোনোটি ৩০ ঘণ্টা পর্যন্ত বসে ছিল।

নার্গিস আক্তার তাঁর বাচ্চাকে নিয়ে সিলেট যাবেন। গত বৃহস্পতিবার ফেনী সদরে ঢোকার মুখে আটকা পড়ে তাঁদের বাসটি। ওই দিন থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত গাড়িতেই বসা। মাঝখানে দুবার কেক ও বিস্কুট কিনে খেতে পেরেছেন। তাঁদের বাসে ৫০ জন যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে শিশু ছিল সাতজন। মোহাম্মদ সাইফুল নামের এক ট্রাকচালক যাবেন ঢাকায়। তিনিও দুই দিন আগে চট্টগ্রাম থেকে মিরসরাই এসে আটকে গেছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, এ রকম শত শত যানবাহন সড়কে আটকে থাকায় অনেকে হেঁটে গন্তব্যে যাচ্ছেন। কেউ পাঁচ ঘণ্টা, কেউ ছয় ঘণ্টা, আবার কেউ ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত হেঁটেছেন।

অরূপ দাশ ও নয়না দাশের বাড়ি সোনাগাজীতে। বন্যায় তাঁদের বাড়িঘর ডুবে গেছে। এ কারণে চট্টগ্রাম থেকে বাড়িতে যাচ্ছেন। তাঁরা সকাল নয়টার দিকে বাসে বারইয়ারহাট আসেন। সেখান থেকে দুই ঘণ্টা হাঁটার পর সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ওঠেন। তারপর আবার হাঁটেন। এ দম্পতির সঙ্গে কথা হয় লেমুয়া রাস্তার মাথা এলাকায়। ক্লান্ত স্বরে দুজন বলেন, যেভাবেই হোক বাড়িতে যেতে হবে।