শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে সর্বনাশ করেছেন, বাংলাদেশের আর কোনো শাসক তা করেননি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে শেখ হাসিনার যে কারবার, এই কারবারের জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করতে হবে। দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশ চলবে। এর ব্যতিক্রম মানুষ মেনে নেবে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে অর্জন, সেগুলোকে কখনো ভূলুণ্ঠিত হতে দেওয়া হবে না।
গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের আয়োজনে শোষণ-বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয় নিয়ে ‘দ্রোহ-দাহ-স্বপ্নযাত্রা’ শীর্ষক সাংস্কৃতিক সমাবেশে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। আজ শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এই সমাবেশ শুরু হয়। চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। এটি ছিল নবগঠিত এই সংগঠনের প্রথম সাংস্কৃতিক সমাবেশ। সমাবেশের শুরুতে জুলাই–আগস্ট অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
সমাবেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি ১৩টি দাবি তুলে ধরে সেগুলো বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান বিবর্তন সংস্কৃতি কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান লাল্টু। দাবিগুলো হলো জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সব অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা; মধ্যস্বত্বভোগী ও লুটেরাদের ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ; দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে উসকানিদাতা অপশক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া; দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার কর্মসূচি শেষ করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা; সংস্কৃতিচর্চার অবাধ ও মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা; সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ সব নিপীড়নমূলক আইন বাতিল; শিল্প–সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অনুদান প্রদানে গঠিত কমিটি পুনর্গঠন করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও সংস্কৃতি খাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া; বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা ও পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া; প্রশাসনের সব পর্যায় থেকে ফ্যাসিবাদের দোসরদের অপসারণ ও নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ বন্ধ করা; পাহাড় ও সমতলে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা ও সেনা প্রত্যাহার; সংবিধান থেকে সব ধরনের বৈষম্য, অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক উপাদান বিলোপ; শিক্ষাঙ্গনে অগণতান্ত্রিক সন্ত্রাসী সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি ও সংস্কৃতিচর্চার মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
সমাবেশে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নিহত ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা প্রায় ১৬ বছর আমাদের বাক্স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই বাক্স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের ছেলেমেয়েরা জীবন দিয়েছে। আমি অত্যন্ত বুকভরা কষ্ট নিয়ে বলতে চাই, নিজের ছেলে হারানোর কষ্ট কেমন, সেটা যাঁরা হারিয়েছেন, তাঁরাই শুধু বুঝবেন। যে বৈষম্যের জন্য আন্দোলন হয়েছিল, সেই বৈষম্যহীন একটা সমাজ আমরা চাই।’
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহসভাপতি জামসেদ আনোয়ার (তপন) বলেন, ‘শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতেন সব সময়, তাঁর নেতা–কর্মীরাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে তাঁরা আমাদের আত্মাকে নষ্ট করে দিয়েছিলেন। তিনি উন্নয়ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দানবের মতো যে কাজগুলো করেছেন, তাতে দেশের অনেক মানুষ মুক্তিযুদ্ধকেই প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে শেখ হাসিনার যে কারবার, এই কারবারের জন্য শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করতে হবে। শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে সর্বনাশ করেছেন, বাংলাদেশের আর কোনো শাসক তা করেননি।’
জামসেদ আনোয়ার আরও বলেন, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদী শক্তি পালিয়েছে। কিন্তু তাদের ফ্যাসিবাদ এখনো রয়ে গেছে। তারা এখনো ষড়যন্ত্র করছে। তাদের রাজনৈতিক বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে।
চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোকে আমরা কখনো ভূলুণ্ঠিত হতে দেব না। আমরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানের চেতনাকে যেমনি ধারণ করি, একইভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ জুলাই গণ–অভ্যুত্থানকেও একইভাবে ধারণ করি।’
সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে প্রগতি লেখক সংঘের কোষাধ্যক্ষ দীনবন্ধু দাশ, কৃষকনেতা রনজিৎ বাওয়ালী প্রমুখ বক্তব্য দেন। আলোচনা সভা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে দলীয় সংগীত পরিবেশন করেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী সায়ানও। এ ছাড়া ছিল আবৃত্তি, ব্যান্ড, রক ও র্যাপ সংগীতের আয়োজন।