দুর্ঘটনার ঝুঁকির সঙ্গে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েও এখন ভয়

বাসে ওঠার পর দুর্ঘটনার ঝুঁকি ছাড়া ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে এত দিন কারও মধ্যে ভয় কাজ করত না। ভাড়ায় অন্য কোনো গাড়িতে ওঠার চেয়ে নিরাপত্তার কথা ভেবেই সাধারণ মানুষ বাসে চড়তে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

তবে এখন পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে গণপরিবহনে ডাকাতি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনায় মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে নারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে গণপরিবহন। বেশ কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, পরিবহনশ্রমিকেরাই ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় বাসের চালক–শ্রমিকেরা জড়িত কি না, তা এখনো জানা যায়নি। সড়ক পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে। এ খাতে বিশৃঙ্খলার দায় সরকার এড়াতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরে চলা অব্যবস্থাপনার কারণেই মূলত গণপরিবহন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।

কোনো মালিক চান না, তাঁর বাসে ডাকাতি-ধর্ষণ হোক। মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে কথা হচ্ছে। দু-চারটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। মালিকদের পক্ষে রাস্তায় রাস্তায় বাস পরীক্ষা করা সম্ভব নয়, হাইওয়ে পুলিশকে আরও তৎপর হতে হবে।
খন্দকার এনায়েত উল্যাহ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব

সরকার এবং পরিবহনমালিক ও শ্রমিক—এ দুই পক্ষের দায়িত্বহীনতায় দিন দিন গণপরিবহন অনিরাপদ হয়ে উঠছে বলে মনে করেন নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মালিক-শ্রমিক সংগঠনে সরকারের লোক থাকে, তারা বেপরোয়া। বাসমালিকদের কাছে ইনকামই (আয়) শেষ কথা, বাসে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা তারা দেখে না। হাইওয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

গত ২৪ জুলাই রাজধানীতে এক নারী শিক্ষার্থী বাসে যৌন নিপীড়নের শিকার হন। বাস থেকে লাফিয়ে নিপীড়কের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেন তিনি। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হলে শিক্ষার্থীকে নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত বাসচালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই ধরনের ঘটনা ঘটছে চট্টগ্রামসহ দেশের অন্য মহানগরেও। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে গণপরিবহনে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৬ জন নারী। ঘটনার শিকার বেশির ভাগই গৃহবধূ ও কারখানার শ্রমিক।

মহাসড়কে ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ঠেকাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সক্ষমতা ও লোকবল অনুযায়ী বিভিন্ন মহাসড়কে নিয়মিত টহল দেওয়া হচ্ছে। এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। পরে ওই বছরের আগস্টের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। একটি নির্দেশনায় বলা হয়, গণপরিবহনে দৃশ্যমান দুটি জায়গায় চালক ও চালকের সহকারীর ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর ও মুঠোফোন নম্বর প্রদর্শন নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এ নির্দেশনা পালন করা হচ্ছে না। রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলা ১০টি বাসে গতকাল বৃহস্পতিবার উঠে দেখা যায়, কোনো বাসেই চালকের ছবিসহ লাইসেন্স, মুঠোফোন নম্বর দৃশ্যমান প্রদর্শন করা হচ্ছে না।

পরিবহন খাত মালিক-শ্রমিকদের দুষ্টচক্রে আটকে আছে। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে হলে এ চক্র ভাঙতে হবে। মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
মো. হাদিউজ্জামান, অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, কোনো মালিক চান না, তাঁর বাসে ডাকাতি-ধর্ষণ হোক। মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে কথা হচ্ছে। দু-চারটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। মালিকদের পক্ষে রাস্তায় রাস্তায় বাস পরীক্ষা করা সম্ভব নয়, হাইওয়ে পুলিশকে আরও তৎপর হতে হবে।

এর আগে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতে টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে এক ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করে রাস্তায় ফেলে দেন আসামিরা। নিহত ছাত্রীর ভাই পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে লাশের ছবি দেখে বোনকে শনাক্ত করেন। এ ঘটনায় করা মামলায় চারজন পরিবহনশ্রমিককে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত।

গত মে মাসে সাভার, নাটোর ও গোপালগঞ্জে পৃথকভাবে তিনটি বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। একই মাসে এ রকম আরও তিনটি ঘটনার কথা জানতে পেরেছে পুলিশ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহন খাত মালিক-শ্রমিকদের দুষ্টচক্রে আটকে আছে। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে হলে এ চক্র ভাঙতে হবে। মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।