আম্রপালি

আমের রাজ্যে ‘নতুন রাজা’

আম্রপালি এখন দেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত আম। রপ্তানিতেও এগিয়ে।

নওগাঁর সাপাহারের কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানার বাগানের গাছে ধরে আছে আম্রপালি আম। সম্প্রতি তোলা
ছবি: সংগৃহীত

স্বাদের দিক দিয়ে আমের রাজা কে—এই প্রশ্নে একেকজনের উত্তর একেক রকম হতেই পারে। কারণ, জাতভেদে আমের স্বাদ ও গন্ধ ভিন্ন। যদি উৎপাদনের হিসাব বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে ‘আমের রাজা’ এখন আম্রপালি। রপ্তানিতেও এই জাতের আম এগিয়ে।

দেশে এখন উৎপাদিত হওয়া প্রতি চারটি আমের একটি আম্রপালি। মানে হলো যত আম উৎপাদিত হয়, তার প্রায় ২৫ শতাংশ আম্রপালি জাতের। এক দশক আগেও যেখানে জনপ্রিয় আম বলতে ল্যাংড়া, হিমসাগর অথবা ফজলিকে বোঝাত, সেখানে এখন আসছে আম্রপালির নাম।

দেশে আমের জাত ৮০০টির বেশি বলে গবেষকেরা উল্লেখ করেন। তবে ২১টি জাতের আম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) কর্মকর্তারা বলছেন, গত এক দশকে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাগান বেড়েছে আম্রপালি জাতের আমের। অন্তত তিনটি কারণে আম্রপালির এমন পসার—মিষ্টতা, স্থায়িত্ব ও সুগন্ধ। পাশাপাশি কোনো বিশেষ এলাকায় এই আমের বাণিজ্যিক বাগান সীমাবদ্ধ নেই। যেখানেই লাগানো হোক, আম্রপালির ভালো ফলন হয় এবং স্বাদও ভালো থাকে।

যেমন খাগড়াছড়ির কৃষি উদ্যোক্তা জ্ঞানজ্যোতি চাকমা প্রথম আলোকে বলছিলেন, পাহাড়ে এখন আম্রপালি একটি অন্যতম বড় জাতে পরিণত হয়েছে। ভালো ফলন ও লাভের সম্ভাবনা বেশি বলেই উদ্যোক্তারা আম্রপালির দিকে ঝুঁকছেন। তিনি জানান, তাঁর ৪০ একর জমির একটি আমবাগান রয়েছে। এর একটি বড় অংশেই রয়েছে আম্রপালি জাতের আমগাছ।

আম্রপালি যেভাবে এল

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এম এনামুল হক

আম্রপালি আমের জাতটি ১৯৭১ সালে উদ্ভাবন করেন ভারতীয় কৃষিবিজ্ঞানী পীযূষ কান্তি মজুমদার। দেশটির কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই বিজ্ঞানী উত্তর ভারতের বিখ্যাত আমের জাত দোসেরি ও দক্ষিণ ভারতের নীলমের সংকরায়ণের মাধ্যমে দুটি জাতের আম উদ্ভাবন করেন—আম্রপালি ও মল্লিকা।

আম গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, দোসেরির ফুলের পুরুষ পরাগ ও নীলমের স্ত্রী পরাগ মিলে হয়েছে আম্রপালি। আর দোসেরির স্ত্রী ও নীলমের পুরুষ পরাগ মিলে হয়েছে মল্লিকা জাতের আম।

প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত গায়িকা ও নর্তকী আম্রপালির নামে আম্রপালি জাতের আমের নামকরণ হয়েছে। তিনি আমবাগানে জন্মেছিলেন। তাই তাঁর নাম রাখা হয়েছিল আম্রপালি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক বিমান চন্দ্র বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভারতের বৈশালী নগরের (এখনকার বিহারে নগরটি ছিল) নর্তকী ছিলেন আম্রপালি। তিনি শেষজীবনে তাঁর সব ধনসম্পদ বিলিয়ে দিয়ে গৌতম বুদ্ধের শিষ্যা হয়ে যান। তাঁর নামে নামকরণের পর আম্রপালি জাতের আমের প্রথম চারা রোপণ করা হয় পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার চাকদহে।

বাংলাদেশে ভারত থেকে আম্রপালি জাতের আমের চারা এনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (১৯৯৬-২০০১) এম এনামুল হকের দাবি, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) একজন কর্মকর্তা ভারতে গিয়ে আম্রপালির কিছু চারা নিয়ে আসেন। তিনি (এনামুল হক) তখন উপপরিচালক হিসেবে ডিএইতে কর্মরত। তিনি কয়েকটি চারা নিয়ে খামারবাড়িতে রোপণ করেন।

এনামুল হক আরও বলেন, তিনি ১৯৯৬ সালে ডিএইর মহাপরিচালক হয়ে আম্রপালির প্রসারে উদ্যোগী হন। তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদে দেশে অন্তত ২০ লাখ আম্রপালির চারা রোপণ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ১৯৯৬ সালে আম্রপালি জাতকে বারি আম-৩ নামে অবমুক্ত করে। কৃষিবিদেরা জানিয়েছেন, বিদেশি জাতের দেশি সংস্করণের এই রীতিকে বলা হয় পরিচিতি বা ইন্ট্রোডাকশন। আম্রপালি অবমুক্তের পেছনে ছিলেন কৃষিবিদ কাজী বদরুদ্দোজা।

সবচেয়ে মিষ্টি আম্রপালি

আম্রপালি খুবই মিষ্টি আম। আমের মিষ্টতা নির্ধারণ করা হয় ব্রিকস মিটার অনুযায়ী। ডিএইর ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক মো. মেহেদী মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, আম্রপালির মিষ্টতার মাত্রা ২৬–এর মতো। এটা সর্বোচ্চ। কাছাকাছি অবস্থানে আছে গৌড়মতী ও হিমসাগর।

আম্রপালির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো এই আম অন্য আমের চেয়ে বেশি সময় টেকে। মানে হলো সহজে পচে যায় না। আর মৌসুমের সময় বেশি সময় ধরে এই আম পাওয়া যায়। ডিএইর কর্মকর্তারা বলছেন, জুনের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের শুরু পর্যন্ত এই আম বাজারে মেলে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও আমবিশেষজ্ঞ এম এ রহিম প্রথম আলোকে বলেন, আম্রপালি আমগাছে পুরুষ ফুল এবং উভয় লিঙ্গের ফুল ধরে। যে গাছে উভয় লিঙ্গের ফুল বেশি ধরে, সে গাছে ফলন বেশি হয়। আম্রপালিতে উভয় লিঙ্গের ফুল ধরার পরিমাণ ৮০ শতাংশের বেশি। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রচলিত আমগুলোর মধ্যে আম্রপালির খাদ্যাংশ সবচেয়ে বেশি, ৭২ শতাংশের মতো।’

আম্রপালি এগিয়ে

ডিএইর হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২১-২২) দেশে সাড়ে ২৩ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ছয় লাখ টনই ছিল আম্রপালি। সে বছর উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা আম হিমসাগর উৎপাদিত হয়েছিল সাড়ে চার লাখ টন। উৎপাদনে আম্রপালি ও হিমসাগরের পরে শীর্ষ পাঁচে রয়েছে হাঁড়িভাঙ্গা, আশ্বিনা ও ল্যাংড়া। আম্রপালি উৎপাদনে এগিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই।

বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত আম রপ্তানি খুব বেশি নয়। তবে যেটুকু রপ্তানি হয়, তার একটা বড় অংশ আম্রপালি। ডিএইর হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৭৫৭ টন আম, যার প্রায় ৭৪ শতাংশ ছিল আম্রপালি।

ডিএইর রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এবারও আম্রপালি রপ্তানি বেশি হচ্ছে।

ডিএইর তথ্য অনুযায়ী, আম উৎপাদনে শীর্ষ দুই জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সুপরিচিত ক্ষীরশাপাতি বা হিমসাগরের জন্য। নওগাঁ পরিচিতি পেয়েছে আম্রপালি উৎপাদন করে।

নওগাঁর সাপাহারের কৃষি উদ্যোক্তা মো. সোহেল রানার ১৫০ বিঘা আয়তনের আমবাগান রয়েছে, যার ৮০ বিঘায় রয়েছে আম্রপালির গাছ। তিনি বলেন, আম্রপালিতে লাভ ভালো।

চারা বিক্রিও বেশি আম্রপালির

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত ফল আম। ২০২১-২২ অর্থবছরে আম উৎপাদিত হয়েছে ১২ লাখ টনের বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কাঁঠাল—প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টন। উল্লেখ্য, ডিএইর সঙ্গে বিবিএসের উৎপাদনের হিসাবে পার্থক্য রয়েছে।

জেলায় জেলায় আমবাগান বাড়ছে। এমনকি দক্ষিণবঙ্গেও কেউ কেউ বাণিজ্যিক আমবাগান করছেন। বাগানে আম্রপালির চারাই বেশি লাগানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ পাঁচটি চারা কিনলে দুটি কেনে আম্রপালির। তাই এর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলেই মনে হয়।