বেসরকারি পর্যায়ে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করতে চাইলে অবকাঠামোগত ২০টি শর্ত মানতে হবে। নিবন্ধন ছাড়া কেন্দ্র পরিচালনা করলে ২ বছরের জেল ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে। এমন বেশ কিছু বিধান রেখে ‘শিশু দিবাযত্ন বিধিমালা, ২০২২’-এর খসড়া প্রস্তুত করেছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
তবে বেসরকারি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনাকারীরা বলছেন, খসড়া বিধিমালা তৈরিতে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়নি। খসড়া বিধিমালার বেশ কিছু বিষয় বাস্তবসম্মত নয়।
অবশ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বেসরকারি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনাকারীদের এখনো সংগঠিতভাবে মতামত দেওয়ার সুযোগ আছে।
খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, ২০২১ সালের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইনের ৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী বেসরকারি পর্যায়ে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপিত হবে।
সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন দিয়ে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ নিয়োগ করবে। বেসরকারি পর্যায়ে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করতে চাইলে নিবন্ধন নিতে হবে।
নিবন্ধন পেতে উদ্যোক্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ টাকা থাকতে হবে। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের জন্য নিবন্ধন ফি ১০ হাজার টাকা।
নিবন্ধন সনদের মেয়াদ হবে তিন বছর। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তা নবায়ন করতে হবে। নবায়ন ফি পাঁচ হাজার টাকা। তবে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ এই ফি বাড়াতে-কমাতে পারবে।
নিবন্ধন ছাড়া কেন্দ্র পরিচালনা করলে ২ বছরের জেল বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।
নিবন্ধন প্রাপ্তির শর্ত অংশে বেশ কিছু ধারা রয়েছে। এতে আবেদনকারীর যোগ্যতার পাশাপাশি কেন্দ্রের অবকাঠামোগত ২০টি শর্ত যুক্ত করা হয়েছে।
প্রত্যেকটি শিশুর জন্য গড়ে ৫০ বর্গফুট জায়গা থাকতে হবে। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের আয়তন সর্বনিম্ন তিন হাজার বর্গফুট হতে হবে।
পাকা ভবনে লিফট না থাকলে সর্বোচ্চ চতুর্থ তলায়, আর লিফট থাকলে সর্বোচ্চ সপ্তম তলায় কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে।
৫০ থেকে ৬০ জন শিশু থাকবে—এমন দিবাযত্ন কেন্দ্রের জন্য ব্যবস্থাপক, শিক্ষক, আয়া, বাবুর্চি, নিরাপত্তাপ্রহরী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী মিলিয়ে মোট ১২ জন কর্মী থাকতে হবে।
৩০ থেকে ৪০ জন শিশু থাকবে—এমন দিবাযত্ন কেন্দ্রের জন্য মোট কর্মী থাকতে হবে ১০ জন। কর্মীদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
খসড়া বিধিমালা অনুযায়ী, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত সেবা দিতে হবে। চার মাস থেকে ছয় বছর বয়সী শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে থাকতে পারবে।
দিবাযত্ন কেন্দ্রের পক্ষ থেকে শিশুর বয়স অনুযায়ী সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার ও বিকেলের নাশতা, অর্থাৎ মোট তিন বেলা খাবার দিতে হবে। খাবারের তালিকা নির্ধারণ করবে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ।
বেসরকারি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সেবামূল্যের ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত—এই দুটি ভাগ করা হয়েছে।
উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কেন্দ্রের শিশু ভর্তি ফি ৫০০ টাকা। মাসিক ফি সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা।
নিম্নবিত্ত শ্রেণির কেন্দ্রে শিশু ভর্তি ফি ৫০০ টাকা। মাসিক ফি সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা।
কোনো শিশু মাসের আংশিক সময় কেন্দ্রে অবস্থান করলেও মাসিক ফির পুরোটা দিতে হবে।
শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন-তত্ত্বাবধানের জন্য কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তিনটি কমিটি করা হবে। কেন্দ্র পরিচালনাকারীরা অভিভাবকদের সঙ্গে বছরে চারটি সভা আয়োজন করবে।
শিশুর নিরাপত্তা, কর্তব্যে অবহেলা, শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের মতো বিষয়ে শাস্তির বিধান খসড়া বিধিমালা রাখা রয়েছে।
বিধিমালার কোনো ধারা লঙ্ঘন করলে কেন্দ্র পরিচালনাকারীকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।
রাজধানীর গুলশান এলাকায় ১২ বছর ধরে একটি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে এই কেন্দ্রে ১৮টি শিশু থাকে। প্রতিটি শিশুর জন্য অভিভাবকদের মাসিক আট হাজার টাকা করে দিতে হয়। ১ হাজার ৮০০ বর্গফুটের এই কেন্দ্রের ভাড়া ৭০ হাজার টাকার বেশি। বর্তমানে কেন্দ্র থেকে শিশুদের কোনো খাবার দেওয়া হয় না।
গুলশানের এই কেন্দ্রটি পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এই বিধিমালা চূড়ান্ত হলে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। বাসাভাড়া, কর্মীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল দিয়ে এখনই হিমশিম খেতে হয়। তিন হাজার বর্গফুটের কেন্দ্র করলে মাসে ভাড়াই আসবে এক লাখ টাকার বেশি। তিন বেলা খাবারসহ মাসিক পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব কীভাবে করা হয়!
মিরপুরের পল্লবী এলাকার একটি দিবাযত্ন কেন্দ্রে বর্তমানে ১৯টি শিশু থাকে। কেন্দ্রটি ১ হাজার ৭৫০ বর্গফুট আয়তনের। এ কেন্দ্রের পরিচালনাকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে তা চাপিয়ে দিলে হবে না। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। শিশুদের যত্নের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। খসড়া বিধিমালায় যেসব শর্ত রাখা হয়েছে, তাতে কেন্দ্র পরিচালনা ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে না।
একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন মাশরুফা চৌধুরী। তিনি তাঁর পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে বেসরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রে রেখে যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রে শিশুর নিরাপত্তা, যত্ন, ভালো পরিবেশ—এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করা জরুরি।
মাশরুফা চৌধুরীর মতে, অভিভাবক ও কেন্দ্র পরিচালনাকারী উভয় পক্ষের মতামত নিয়ে বিধিমালার শর্তগুলো চূড়ান্ত করা ভালো। তবে আইন-বিধি, যেটাই করা হোক না কেন, তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
মতামতের সুযোগ আছে
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শিশু ও সমন্বয়) মুহিবুজ্জামান বলেন, খসড়া বিধিমালাটি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। বিদ্যমান বেসরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলোর নিবন্ধন না থাকায় তাদের মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি।
মুহিবুজ্জামান বলেন, বেসরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনাকারীরা সংগঠিত হয়ে মতামত দিতে চাইলে, তাঁদের সে সুযোগ দেওয়া হবে।