পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার সময় আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক শ্রমিক। আহত পুলিশের পাঁচ সদস্য।
আন্দোলনে নেমেছেন পোশাকশ্রমিকেরা। গতকাল বুধবার গাজীপুর মহানগরীর পাঁচটি জায়গায় থেমে থেমে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে পুলিশ। এ সময় এক নারী শ্রমিক নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক শ্রমিক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুপুরের মধ্যেই অনেক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়।
সংঘর্ষের সময় নিহত নারী শ্রমিক মোসা. আঞ্জুয়ারা খাতুন (৩০) সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের চরগিরিশ গ্রামের মো. জামালের স্ত্রী। গাজীপুরের কোনাবাড়ীর তৈরি পোশাকের একটি কারখানায় সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে তিনি কাজ করতেন। কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় তিনি আহত হন।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম আশরাফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিক-পুলিশ পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার সময় ওই নারী আহত হলে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
ইসলাম গার্মেন্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন আঞ্জুয়ারা। তাঁর স্বামী মো. জামাল কাজ করেন ডিজাইন প্রিন্টিং নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে।
গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে কথা হয় জামালের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর স্ত্রী শ্রমিক বিক্ষোভে ছিলেন না। সকাল আটটার দিকে মাইকে আঞ্জুয়ারার কারখানা ছুটির ঘোষণা আসে। তখন স্ত্রীকে বাসায় যেতে বলেন তিনি। বাসায় যাওয়ার সময় হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়। একটি গুলি এসে আঞ্জুয়ারার মাথায় লাগে।
গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আঞ্জুয়ারার লাশের সুরতহাল করা হয়। পরে তাঁর লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আঞ্জুয়ারার মাথায় গুলির আঘাতের কোনো চিহ্ন তিনি পাননি। তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্নগুলো দেখে মনে হয়েছে, হুড়োহুড়ির সময় আঞ্জুয়ারা মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন মানুষের পায়ের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
আঞ্জুয়ারাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনার পর রেজিস্টারে ‘গুলির আঘাতজনিত’ সমস্যায় আহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই আঞ্জুয়ারা মারা যান। তাঁকে জরুরি বিভাগে আনার পর স্বজনেরা বলেছেন, গুলিতে আহত হয়েছেন। সেটিই প্রাথমিকভাবে রেজিস্টারে লেখা হয়েছে।
গত ২৩ অক্টোবর থেকে বেতন বাড়ানোর দাবিতে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করে আসছিলেন। এরপর গত মঙ্গলবার ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে সরকার।
ঘোষিত মজুরি প্রত্যাখ্যান করে গতকাল সকাল থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ী, জরুন, বাইমাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকেরা বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে কাঠ ও টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন যানবাহন ভাঙচুরের চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। শ্রমিকেরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। পরে পুলিশ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ সময় পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেটের আঘাতে অন্তত ১০ শ্রমিক আহত হন বলে জানা যায়। তাঁদের উদ্ধার করে বিভিন্ন ক্লিনিক ও গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শিল্প পুলিশ জানায়, সকালের শ্রমিক বিক্ষোভে একজন নিহত হলেও পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা ভালোভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। দুপুরের পর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শ্রমিকেরা আবার বিক্ষোভে নামেন। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের নাওজোড় এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান শ্রমিকেরা। এ সময় পুলিশের পাঁচ সদস্য আহত হন। তখন পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি, র্যাবের সমন্বয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে শ্রমিকেরা পিছু হটেন।
কিছুক্ষণ পর ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন শ্রমিকেরা। একপর্যায়ে ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের সামনের মহাসড়কে টায়ারে আগুন দেন তাঁরা। একই সময়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকা থেকে শিববাড়ী পর্যন্ত শ্রমিকেরা দুই পাশে বিভিন্ন ভবনে ভাঙচুর চালান। এ সময় দুই মহাসড়ক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। সর্বশেষ রাত ১০টায় সড়কে কোনো শ্রমিক ছিলেন না। টহল দিচ্ছিল শিল্প পুলিশ ও থানা-পুলিশ।
গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম জানান, হাসপাতালটিতে পুলিশের আহত পাঁচ সদস্যকে আনা হয়। এর মধ্যে গুরুতর আহত পুলিশ সদস্য প্রবীর (৩০), ফুয়াদ হোসেন (২৮) ও খোরশেদ আলমকে (৩০) উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আশিকুল ইসলাম (২৭) ও বিপুলকে (২৪) হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ফুয়াদের অবস্থা বেশি গুরুতর। বিস্ফোরণে তাঁর ডান হাতের কবজি থেঁতলে গেছে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেন, শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে পুলিশের আট সদস্য আহত হয়েছেন।
এদিকে গাজীপুরে পোশাক কারখানার নিরাপত্তায় ১৫ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মো. সফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, শ্রমিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বিভিন্ন দলের ডাকা অবরোধের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্তসংখ্যক বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
হামলা-ভাঙচুরের সঙ্গে শ্রমিকেরা জড়িত নন দাবি করে গাজীপুর মহানগরের গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের সুযোগে অন্য কেউ হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটাচ্ছে।’
মো. রায়হান নামের নাওজোড় এলাকার একটি পোশাক কারখানার একজন শ্রমিক বলেন, ‘আমরা যে বেতন এত দিন ধরে দাবি করে আসছিলাম, তার ধারেকাছেও নির্ধারণ করা হয়নি। ১২ হাজার ৫০০ টাকা খুবই কম। এই টাকায় সংসার চালানো খুবই কষ্ট। যার কারণে বাধ্য হয়েই রাস্তায় নামতে হয়েছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন করে যাব।’
ন্যূনতম বেতন ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে আশুলিয়ায়ও পোশাকশ্রমিকেরা বিক্ষোভে নামেন। সকাল থেকে তাঁরা কাজ না করে বসে থাকেন। পরে দুপুরের মধ্যেই ওই কারখানাগুলো ছুটি ঘোষণা করা হয়। আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কে শ্রমিকেরা জড়ো হলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহমুদ নাসের বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ১০-১৫টি কারখানা ছুটি দেওয়া হয়।