দেশি সরবরাহ বাড়াতে বড় পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কম। নতুন গ্যাস যোগ করার লক্ষ্য পূরণ হয়েছে মাত্র ৯%।
সংকট কাটাতে দেশি গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছিল সরকার। নতুন নতুন কূপ খননের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও পিছিয়ে সরকারি সংস্থাগুলো।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে চার বছরে ৪৬টি কূপ খনন করার লক্ষ্য ঠিক করেছিল। এর মধ্যে প্রথম দুই বছর, অর্থাৎ ২০২২ ও ২০২৩ সালের মধ্যে ২১টি কূপ খননের কথা। যদিও হয়েছে মাত্র ৯টি। একই সময়ের মধ্যে নতুন কূপ থেকে জাতীয় গ্রিডে দিনে ২৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হওয়ার কথা। হয়েছে মাত্র আড়াই কোটি ঘনফুট, যা লক্ষ্যমাত্রার ৯ শতাংশ।
স্থলভাগে গ্যাসকূপ খননের যখন এই অবস্থা, তখন সমুদ্রে আরও পিছিয়ে সরকার। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন—পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির এক যুগ পরও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে তেমন গতি নেই।
দাম বাড়ানোর আগে গ্যাসের যে পরিস্থিতি ছিল, তার চেয়ে অবস্থা এখন খারাপ। অনেক কারখানা এখন বন্ধ আছে। এভাবে চলতে থাকলে আরও কারখানা বন্ধ হবে।মোহাম্মদ আলী, সভাপতি, বিটিএমএ
উত্তোলনের পর কোম্পানিগুলোর সঙ্গে গ্যাস ভাগাভাগি নিয়ে নতুন উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের ছয় মাস পার হয়েছে। যদিও দরপত্র ডাকা হয়নি।
এদিকে স্থলভাগের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বছর বছর কমছে। বিদেশ থেকে আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না মার্কিন ডলারের সংকটে।
সব মিলিয়ে দেশে গ্যাস–সংকট থাকছেই। এর মধ্যেই বিদেশ থেকে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনালে কারিগরি ত্রুটির কারণে ১৯ জানুয়ারি দিনভর গ্যাস বিপর্যয়ের ভোগান্তিতে ছিল চট্টগ্রামসহ ছয় জেলা। গত শনিবার থেকে আবার এলএনজি সরবরাহ শুরু হয়েছে। তবে চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর সূত্র বলছে, এলএনজি টার্মিনালের ত্রুটি মেরামত করা গেলেও বছরজুড়েই গ্যাস–সংকট থাকতে পারে। এতে শিল্পকারখানা যেমন ভুগবে, তেমনি রান্না ও পরিবহনে গ্যাস না পেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হবে সাধারণ মানুষকে।
সবগুলো কূপ খনন হলে দিনে প্রায় ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়বে বলে তখন জানানো হয়েছিল, যা এখনকার সরবরাহের প্রায় ২৫ শতাংশের সমান।
২০২২ সালে ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের দাবি করে প্রয়োজনে বাড়তি দাম দেওয়ার কথা বলেছিলেন। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সরকার গ্যাসের দাম ১৮০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু গ্যাসের সংকট কাটেনি। এখন ব্যবসায়ীদের বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে, কিন্তু কারখানা চালাতে দুর্ভোগ রয়েই গেছে।
বস্ত্র খাতের কারখানামালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, দাম বাড়ানোর আগে গ্যাসের যে পরিস্থিতি ছিল, তার চেয়ে অবস্থা এখন খারাপ। অনেক কারখানা এখন বন্ধ আছে। এভাবে চলতে থাকলে আরও কারখানা বন্ধ হবে।
দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা গেলে চাহিদা মোটামুটি পূরণ করা যায়। দুই মাস ধরে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৫০ কোটি ঘনফুটের কম। এর মধ্যে ২০০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ করা হয় দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করে। বাকিটা আমদানি করা এলএনজি।
২০১৮ সালে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে সরকার। যদিও আমদানিনির্ভরতার ঝুঁকি নিয়ে শুরু থেকেই সতর্ক করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা দেশেই উত্তোলন বাড়ানোর পরামর্শ দেন। তবে সরকার আমদানিতে ঝোঁকে। কিন্তু মার্কিন ডলারের সংকটে পড়ে ২০২২ সালে এলএনজি আমদানি কমানো হয়।
দাম বাড়ানোর আগে গ্যাসের যে পরিস্থিতি ছিল, তার চেয়ে অবস্থা এখন খারাপ। অনেক কারখানা এখন বন্ধ আছে। এভাবে চলতে থাকলে আরও কারখানা বন্ধ হবে।বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী
এরপর নতুন করে দেশি গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। বলা হয়, দ্রুত গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এর মধ্যে ২০২২ সালে ৬টি ও ২০২৩ সালে ১৫টি কূপ খননের কথা।
সবগুলো কূপ খনন হলে দিনে প্রায় ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়বে বলে তখন জানানো হয়েছিল, যা এখনকার সরবরাহের প্রায় ২৫ শতাংশের সমান।
জ্বালানি বিভাগের সূত্র জানিয়েছে, নির্ধারিত সময়ে খনন করা হয়েছে ৯টি কূপ খননের পাশাপাশি কাজ চলছে তিনটির। চলতি বছর ১৪টি ও ২০২৫ সালে ১১টি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে নতুন করে আরও ১০০ কূপ খননের কথা বলছে জ্বালানি বিভাগ।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি মোট ১৪টি কূপ খনন করবে। প্রথম দুই বছরে ৭টি শেষ করার কথা ছিল। তবে তিনটির কাজ শেষ হয়েছে। আর চলছে একটি কাজ, যা এক মাসের মধ্যে শেষ হতে পারে।
দেরি কেন
খনিজ সম্পদ উত্তোলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত করপোরেশন পেট্রোবাংলা। তাদের অধীনে থাকা তিনটি কোম্পানি গ্যাস উত্তোলনের সঙ্গে যুক্ত—বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স), বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিএফএল)। এর মধ্যে একমাত্র বাপেক্সের কূপ খননের সক্ষমতা আছে। আর বাকি দুটি কোম্পানি ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ করায়।
পেট্রোবাংলা ও তিন কোম্পানির দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে যথাসময়ে কূপ খনন করতে না পারার কয়েকটি কারণ জানা গেছে। তাঁরা বলছেন, চার বছরে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনাটিই বাস্তবসম্মত হয়নি। বছরে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিনটি কূপ খননের অভিজ্ঞতা আছে বাংলাদেশের। চাইলেই কম সময়ে বেশি কূপ খনন করা সম্ভব নয়। ফলে ২০২৫ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরও বলছেন, কূপ খননে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুমোদন করতেই লাগে এক বছরের বেশি। এরপর জমি অধিগ্রহণ ও যন্ত্রপাতি কিনতে লাগে কয়েক মাস। খনন শুরুর পর একটি অনুসন্ধান বা উন্নয়ন কূপ শেষ করতে লাগে অন্তত সাড়ে তিন মাস। আর সংস্কার কূপ খননে লাগে দুই মাস। কর্মকর্তারা বলছেন, মুখে অনেক কথা বলা যায়, পরিকল্পনা করা যায়। তবে বাস্তবায়ন করা কঠিন। একই সময়ে একাধিক বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করাতে পারলে বেশি কূপ খনন করা সম্ভব।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আব্দুল মান্নান পাটওয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হলে কূপ খননের কাজে গতি বাড়বে।
কূপ খননে ধীরগতি
চার বছরে পেট্রোবাংলার অধীন কোম্পানি বাপেক্সের ২০টি কূপ খননের কথা। প্রথম দুই বছরে তাদের লক্ষ্য ছিল ১০টি কূপ খনন। যদিও খনন হয়েছে ৫টি।
বাপেক্স সূত্র জানায়, তারা ভোলায় তিনটি কূপ খননের কাজ আগে থেকেই করছিল। তিনটিতেই গ্যাস পাওয়া গেছে। শরীয়তপুরে একটি কূপ খনন করে গ্যাস পাওয়া যায়নি। কুমিল্লার শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্রে কূপ খনন করে গ্যাস পাওয়া গেলেও তা উত্তোলনের জন্য বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক নয়। এ ছাড়া নোয়াখালীর সুন্দলপুরে একটি কূপ খননের কাজ আগামী মাসে শেষ হতে পারে। এরপর একই জেলার বেগমগঞ্জে একটি কূপ খননের কাজ শুরু হবে।
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সবগুলো কূপ খননের চেষ্টা চলছে।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি মোট ১৪টি কূপ খনন করবে। প্রথম দুই বছরে ৭টি শেষ করার কথা ছিল। তবে তিনটির কাজ শেষ হয়েছে। আর চলছে একটি কাজ, যা এক মাসের মধ্যে শেষ হতে পারে। কোম্পানিটি সূত্র জানিয়েছে, তাদের খনন করা দুটি কূপ থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ ঘনফুট গ্যাস নতুন যুক্ত হয়েছে গ্রিডে। আর একটি অনুসন্ধান কূপে নতুন গ্যাস পাওয়ার পাশাপাশি তেলও পাওয়া গেছে। তবে এটি থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে আরও অন্তত ৮ মাস সময় লাগতে পারে।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জমি অধিগ্রহণ, ঠিকাদার নিয়োগ, খননের যন্ত্রপাতি আনায় সময় লেগে যায়। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সবগুলো শেষ করা হবে।
বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) ১২টি কূপ খনন করার কথা। এর মধ্যে ২০২৩ সালের মধ্যে ৪টির খনন শেষ হওয়ার কথা ছিল। তারা একটির কাজ শেষ করতে পেরেছে। এ কূপ থেকে গ্রিডে নতুন করে ৮৫ লাখ ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। আরেকটি সংস্কার কূপের কাজ এ মাসের শেষে শুরু হতে পারে। মোট ৮টি সংস্কার কূপের মধ্য বাকি ছয়টির জন্য ডিপিপি জ্বালানি বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চারটি উন্নয়ন কূপ খনন করা হবে, যার এখনো ডিপিপি তৈরি হয়নি।
অর্থায়ন নিশ্চিত হলে ডিপিপি চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুস সুলতান।
চুক্তির অপেক্ষায় তিন বিদেশি কোম্পানি
কূপ খননে দেশি কোম্পানি বাপেক্সের পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানিও কাজ করছে। বিদেশি কোম্পানির মধ্যে আছে রাশিয়ার গাজপ্রম, চীনের সিনোপ্যাক ও উজবেকিস্তানের এরিয়েল করপোরেশন। বিদেশিদের সাধারণ দরপত্র ছাড়া কাজ দেওয়া হয়।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, সিনোপ্যাক পেট্রোলিয়াম করপোরেশন পাঁচটি কূপ খননের কাজ পাচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ২০টি কূপ খননের কাজ পেয়েছে গাজপ্রম। নতুন করে আরও পাঁচটি কূপ খননের কাজ পাচ্ছে তারা।
জ্বালানি বিভাগের যুক্তি হলো, বাপেক্সের একা কূপ খনন দীর্ঘ সময় লাগবে। তাই বিদেশিদের কাজ দেওয়া হচ্ছে। যদিও বাপেক্সের সক্ষমতা না বাড়িয়ে বিদেশিদের কাজ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, আমদানিনির্ভরতাই সরকারকে বিপাকে ফেলেছে। ভুক্তভোগী হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা ও সাধারণ মানুষ। বিপাকে পড়ে দেশীয় গ্যাস উত্তোলনের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়।