সারা দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ চলছে শিক্ষকের ঘাটতি নিয়ে। এই ঘাটতির মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন চিকিৎসক।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের নিজস্ব কোনো হাসপাতাল নেই। হাতেকলমে শিখতে ও সন্ধ্যাকালীন পাঠ নিতে শিক্ষার্থীদের যেতে হয় জেলা সদর হাসপাতালে। প্রতিদিন চারবার যাওয়া-আসায় কমপক্ষে চার ঘণ্টা সময় চলে যায়। এভাবে চলছে ১২ বছর।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০০৮ সালে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। কলেজটি ঝিলংজা ইউনিয়নে। আর সদর হাসপাতাল শহরের মধ্যে। কলেজ ও হাসপাতালের দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। যাওয়া-আসা করতে হয় শহরের মধ্য দিয়ে।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমবিবিএস তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লিনিক্যাল ক্লাস করতে হয় দিনে দুবার, সকালে ও সন্ধ্যায়। একবার যেতে এক ঘণ্টা সময় যায়। এভাবে দুবার যাওয়া ও দুবার আসায় প্রতিদিন চার ঘণ্টা সময় চলে যায়। শিক্ষার্থীদের ওপর বড় চাপ যাচ্ছে।’
সমস্যাটি বহু বছরের পুরোনো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সদিচ্ছার অভাবে তা দূর হচ্ছে না। প্রথমে মৌলিক বিষয়গুলোতে কত শিক্ষক দরকার, তা নির্ণয় করতে হবে।অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ, সাবেক অধ্যক্ষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ
কলেজে আরও সমস্যা আছে। গত শনিবার পঞ্চম বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, কলেজে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নেই। প্রত্যেক বিভাগে শিক্ষকের স্বল্পতা আছে। অফথালমোলজি বা চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগে একজনও শিক্ষক নেই।
কলেজ কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে একজন অধ্যক্ষসহ শিক্ষকের পদ আছে ৯৫টি। এর মধ্যে ৪২ জন শিক্ষকের পদ খালি। এই কলেজে অধ্যাপকের পদ আছে ১৫টি, এর মধ্যে ১২টি পদই খালি। কলেজ পড়ানোর কাজ চালাচ্ছেন মূলত প্রভাষকেরা। তাঁদের পদ আছে ২৫টি, তাঁদের মধ্যে আছেন ২১ জন। ৪৪ শতাংশ শিক্ষক ছাড়াই চলছে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ।
তবে এ অবস্থা শুধু একটি সরকারি কলেজের নয়। দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৩৭টি। প্রায় সব মেডিকেল কলেজ তীব্র শিক্ষক–সংকটের মধ্যে আছে। পর্যাপ্ত শিক্ষক ছাড়া যথাযথ পাঠদান ও পাঠ গ্রহণ সম্ভব না। যথাযথ পাঠ গ্রহণ ছাড়াই প্রতিবছর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করে চিকিৎসকের পেশাজীবন শুরু করছেন। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজে ৪২ শতাংশ শিক্ষকের পদ খালি।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি দেশের প্রবীণ চিকিৎসক অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, সঠিক শিক্ষা ও হাসপাতালে হাতে-কলমে দক্ষতা বাড়াতে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক দরকার। শিক্ষক–স্বল্পতার অর্থ অচ্ছে, সঠিক শিক্ষা না পাওয়া, দক্ষ হয়ে না ওঠা। এর পরিণতি হচ্ছে, ঠিক চিকিৎসা দিতে না–পারা বা ঠিক চিকিৎসা না পাওয়া। এটাই এখনকার বাস্তবতা।
তবে এ অবস্থা শুধু একটি সরকারি কলেজের নয়। দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৩৭টি। প্রায় সব মেডিকেল কলেজ তীব্র শিক্ষক–সংকটের মধ্যে আছে। পর্যাপ্ত শিক্ষক ছাড়া যথাযথ পাঠদান ও পাঠ গ্রহণ সম্ভব না।
মৌলিক সমস্যা ৮ বিষয়ে
মেডিকেল শিক্ষায় আটটি বিষয়কে মৌলিক বিষয় বা বেসিক সাবজেক্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এগুলো হচ্ছে অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যা, শারীরবৃত্ত, প্রাণরসায়ন, কমিউনিটি মেডিসিন, ওষুধবিজ্ঞান, চিকিৎসা আইন, রোগবিদ্যা ও অণুজীববিজ্ঞান। সরকারি সব মেডিকেল কলেজে এই আটটি মৌলিক বিষয়ের শিক্ষকস্বল্পতা আছে।
গত শুক্রবার কক্সবাজারের একটি হোটেলে চিকিৎসক অধ্যক্ষদের একটি সম্মেলনের আয়োজন করে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। সম্মেলনে ৩৬টি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধিসহ স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিব, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের শুরুর দিকে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ ৩৭টি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরেন।
অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যা, শারীরবৃত্ত, প্রাণরসায়ন, কমিউনিটি মেডিসিন, ওষুধবিজ্ঞান, চিকিৎসা আইন, রোগবিদ্যা ও অণুজীববিজ্ঞান। সরকারি সব মেডিকেল কলেজে এই আটটি মৌলিক বিষয়ের শিক্ষকস্বল্পতা আছে।
এসব তথ্যে দেখা যায়, মেডিকেল কলেজগুলোয় ৮টি মৌলিক বিষয়ে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, কিউরেটর ও প্রভাষকের পদ আছে ২ হাজার ৫টি। এর মধ্যে ৫৮৮টি পদে কোনো শিক্ষক নেই। অর্থাৎ মৌলিক বিষয়ে গড়ে ২৯ শতাংশ শিক্ষক ছাড়াই সারা দেশে মেডিকেল শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
এসব শিক্ষকের মধ্যে অভিজ্ঞতায় ও দক্ষতায় এগিয়ে থাকেন অধ্যাপকেরা। কিন্তু সারা দেশে অধ্যাপকের সংকট চলছে। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় মৌলিক বিষয়ে অধ্যাপকের পদ আছে ২১৩টি, কাজ করছেন ৬৫ জন। অর্থাৎ মৌলিক বিষয়ে ৭০ শতাংশ অধ্যাপকের পদ খালি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৌলিক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার আগ্রহ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কম। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পেশা চর্চার আগ্রহ বেশি থাকে। সেই সুযোগ আছে ক্লিনিক্যাল বিষয়গুলোয়। ক্লিনিক্যাল বিষয়ে সুনাম ও অর্থ দুটিই আছে।
সমস্যাটি বহু বছরের পুরোনো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সদিচ্ছার অভাবে তা দূর হচ্ছে না। প্রথমে মৌলিক বিষয়গুলোতে কত শিক্ষক দরকার, তা নির্ণয় করতে হবে। এসব বিষয়ে যাঁরা শিক্ষক হবেন, তাঁরা বাড়তি আর্থিক সুবিধাসহ অন্যান্য কী প্রণোদনা পাবেন, তা ঘোষণা করতে হবে। তাঁরা যেন এই বার্তা পান যে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ, তাঁদের প্রয়োজন খুব বেশি। শিক্ষকতায় যাঁরা আসবেন, তাঁদের সরকার কী দিতে পারছে, সে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ
হৃদ্রোগবিশেষজ্ঞ, কিডনিবিশেষজ্ঞ, ক্যানসারবিশেষজ্ঞ, চক্ষুবিশেষজ্ঞ, স্নায়ুরোগবিশেষজ্ঞ, স্ত্রী রোগবিশেষজ্ঞ হওয়ার আগ্রহ যত বেশি, সেই আগ্রহ দেখা যায় না ওই আটটি বিষয়ে। অথচ ওই আটটি বিষয় হচ্ছে মেডিকেল শিক্ষার ভিত্তি। ওইগুলো না জানলে, না বুঝলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়া সম্ভব না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যাটি বহু বছরের পুরোনো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সদিচ্ছার অভাবে তা দূর হচ্ছে না। প্রথমে মৌলিক বিষয়গুলোতে কত শিক্ষক দরকার, তা নির্ণয় করতে হবে। এসব বিষয়ে যাঁরা শিক্ষক হবেন, তাঁরা বাড়তি আর্থিক সুবিধাসহ অন্যান্য কী প্রণোদনা পাবেন, তা ঘোষণা করতে হবে। তাঁরা যেন এই বার্তা পান যে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ, তাঁদের প্রয়োজন খুব বেশি। শিক্ষকতায় যাঁরা আসবেন, তাঁদের সরকার কী দিতে পারছে, সে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা দিতে হলে নিরাপদ চিকিৎসক তৈরি করতে হবে। শিক্ষকসংকট বজায় রেখে তা করা সম্ভব না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুজন সচিব এবং দুই অধিদপ্তরের দুই মহাপরিচালককে সঙ্গে নিয়ে, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে শিক্ষকসংকট সমাধানের চেষ্টা করবেন।স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন
সমস্যা সব ক্ষেত্রে
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে মেডিকেল শিক্ষায় সরকারি কলেজে মৌলিক ও ক্লিনিক্যাল বিষয়ে শিক্ষকের পদ আছে ৫ হাজার ৯২০টি। এর মধ্যে শিক্ষক নেই ২ হাজার ৪৫৯টি পদে। এর মধ্যে আটটি মৌলিক বিষয়ে ২৯ শতাংশ শিক্ষকের পদ খালি, অন্যান্য ক্লিনিক্যাল বিষয়ে ৪৮ শতাংশ পদ খালি। সামগ্রিকভাবে ৪২ শতাংশ শিক্ষকের পদ খালি।
একাধিক মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের নীতির কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে শূন্য পদের সংখ্যা এত হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ অভিযোগ করেন, বহু এফসিপিএস, এমডি, এমএস ডিগ্রি নেওয়া চিকিৎসকেরা উপজেলা পর্যায়ে কাজ করছেন। তাঁদের পদোন্নতি দিয়ে সহজেই শিক্ষকতায় আনা যায়। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের কাজের সমন্বয়ের অভাবে এই সহজ কাজটি হচ্ছে না।
গত শুক্রবার চিকিৎসক অধ্যক্ষ সম্মেলনে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষকসংকটের কথা বিস্তারিত আলোচনা হয়। অধ্যক্ষদের বক্তব্যে মেডিকেল কলেজগুলোয় বিরাজমান নানা সমস্যার পাশাপাশি শিক্ষকসংকটের কথা বিশেষভাবে আলোচিত হয়।
সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা দিতে হলে নিরাপদ চিকিৎসক তৈরি করতে হবে। শিক্ষকসংকট বজায় রেখে তা করা সম্ভব না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুজন সচিব এবং দুই অধিদপ্তরের দুই মহাপরিচালককে সঙ্গে নিয়ে, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে শিক্ষকসংকট সমাধানের চেষ্টা করবেন।