অসীমার বেঁচে থাকার ‘অলৌকিক’ গল্প

শিশু অসীমা। তখন তাঁর নাম ছিল ভাগ্যশ্রী। শৈশবে বেসরকারি সংস্থার আশ্রয়ে থাকার সময় তোলা
ছবি: শামীম খানের সৌজন্যে

মেয়েটি অসীম ভাগ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছেন। এখন তাঁর যে জীবন, একে বোনাস বলা যায়। তাঁর তো বেঁচে থাকারই কথা ছিল না। অলৌকিকভাবে বেঁচে আছেন মেয়েটা—কথাগুলো বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শামীম খান। মেয়ে অসীমা খানকে নিয়ে তাঁর এই মন্তব্য।

অসীমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাটি জানতে হলে ফিরতে হবে ২০০৬ সালের মে মাসে। তখন অসীমার বয়স আনুমানিক ৮ মাস। অপহরণের শিকার হয় শিশুটি। শুধু তা–ই নয়, অপহরণের ঘটনায় জড়িত এক কিশোরী মালবাহী ট্রেনে করে শিশুটিকে নিয়ে যাচ্ছিল। নরসিংদীর খানাবাড়ি স্টেশনের কাছে ওই কিশোরীর কাছ থেকে অসাবধানতাবশত ট্রেনের নিচে পড়ে যায় শিশুটি। গুরুতর আহত হয় সে। একটি পা কেটে যায়। আঘাত লাগে মাথায়।

নরসিংদীর স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি শিশুটির চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। বিষয়টি আদালতে গড়ায়। দীর্ঘদিন মামলা চলে। তবে শিশুটির পরিবারের খোঁজ মেলেনি। ঠাঁই হয় রাজধানী ঢাকায়, সেন্টার ফর ট্রেনিং অ্যান্ড রিহেভিলিটেশন ফর ডেসটিটিউট উইমেন নামের একটি বেসরকারি সংস্থার আশ্রয়ে। ওই সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তিরা শিশুটির নাম দিয়েছিলেন ‘ভাগ্যশ্রী’।

শামীম খানের সঙ্গে কথা বলে ও মামলার নথি ঘেঁটে জানা যায়, ওই সময় বেলাল ও রহিমা নামের দুজন ছোট্ট শিশুটিকে অপহরণ করেছিলেন। তাঁরা জবানবন্দিতে একবার বলেছেন টঙ্গী থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। আরেকবার বলেছেন, রাজধানীর তেজগাঁও থেকে শিশুটিকে চুরি করেছিলেন তাঁরা।

‘ভাগ্যশ্রী’ থেকে ‘অসীমা’

২০০৬ সাল থেকে শামীম খান ও নীতা আফরোজা খান দম্পতি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। শামীম খান যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বাস স্টেট ইউনিভার্সিটির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। রিমি খান, তেসা শামীম খান ও শায়লা সাহেরা খান নামের তিন মেয়ে এই দম্পতির। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অসীমাও। তাই শামীম ও নীতার ঘরে এখন চার মেয়ে। শামীম খান অসীমার আইনি অভিভাবক।

কিন্তু ঢাকার সেই ‘ভাগ্যশ্রী’ কীভাবে ‘অসীমা’ হলেন? কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমালেন?

মা নীতা আফরোজা খানের সঙ্গে অসীমা খান

২০০৮ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। শামীম খানের শ্বশুর থাকেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে। শ্বশুরকে জানিয়েছিলেন, তিনি ও নীতা একটা মেয়েশিশুর অভিভাবকত্ব নিতে চান। সেন্টার ফর ট্রেনিং অ্যান্ড রিহেভিলিটেশন ফর ডেসটিটিউট উইমেনের আশ্রয়ে থাকা ভাগ্যশ্রীর কথা শ্বশুর তাঁকে জানান।

এক পা কাটা ছোট্ট শিশুটির ছবি দেখে শামীম ও নীতা দম্পতির ভালো লেগে যায়। তাঁরা শিশুটিকে নিতে আগ্রহী হন। আদালতের মাধ্যমে যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে নতুন মা–বাবার হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছায় ছোট্ট শিশুটি। ভাগ্যশ্রীর নতুন নাম হয় অসীমা।

আমার কাছে চার মেয়েই সমান প্রিয়। তবে অসীমার জন্য মনের মধ্যে একটি স্পেশাল জায়গা আছে। একদম ছোটবেলায় সে তার মাকে হারিয়েছে। উদ্ধার করা সম্ভব না হলে, আমরা না পেলে মেয়েটা যে কোথায় ভেসে যেত, কেউ তা জানে না। তাই মেয়েটির জন্য বিশেষ অনুভূতি কাজ করে।
শামীম খান, অসীমার বাবা

যুক্তরাষ্ট্রে নতুন জীবন

যুক্তরাষ্ট্রে শিশু অসীমার গল্পটা একেবারেই ভিন্ন। সেখানে পারিবারিক আবহে বড় হতে থাকে সে। শামীম খান বেশ গর্বের সঙ্গেই বললেন, ‘আমার চার মেয়ের একজন অসীমা। মেয়েটা বেশ চটপটে, স্মার্ট।’

শামীম খান আরও বলেন, ‘আমার কাছে চার মেয়েই সমান প্রিয়। তবে অসীমার জন্য মনের মধ্যে একটি স্পেশাল জায়গা আছে। একদম ছোটবেলায় সে তার মাকে হারিয়েছে। উদ্ধার করা সম্ভব না হলে, আমরা না পেলে মেয়েটা যে কোথায় ভেসে যেত, কেউ তা জানে না। তাই মেয়েটির জন্য বিশেষ অনুভূতি কাজ করে।’

বাবা–মা ও বোনের সঙ্গে অসীমা খান

অসীমার বয়স এখন প্রায় ১৯ বছর। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন তিনি। এখন থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে। কৃত্রিম পা লাগিয়ে চলাফেরা করেন। দাপিয়ে বেড়ান ক্যাম্পাসে।

অসীমার বয়স যখন ৯ বছর, তখন শৈশবে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো জানতে পারেন তিনি। শামীম খান বলেন, ‘জানার পর অসীমার মুখটা গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। তবে এমন একটা ভঙ্গি করেছিল, যেন কোনো ব্যাপার না। পরে জিজ্ঞাসা করেছিল, “তোমরা কি আমাকে আমার আসল মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেবে?” তখন তাকে বলা হয়, তোমাকে কোথাও পাঠানো হবে না।’

আসল মায়ের খোঁজে

বড় হতে হতে অসীমার মধ্যে তাঁর আসল মায়ের মুখ দেখার, নিজের আসল পরিচয় জানার আগ্রহ তৈরি হয়, এমনটাই জানান শামীম খান।

ব্যক্তিগত কাজে দেশে এসেছিলেন শামীম খান। ব্যস্ততার ফাঁকে ৬ নভেম্বর তিনি কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে আসেন। অসীমার গল্পগুলো শোনান। এর আগে ২০০৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এসব গল্প নিয়ে প্রথম আলোর ছুটির দিনে পাতায় ‘অপহরণের কবল থেকে মায়ের কোলে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল।

নরসিংদীতে আলম ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে অসীমা খান। ২০২৩ সালে তোলা

শামীম খান জানান, মায়ের খোঁজে অসীমা দুবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। প্রথমবার ২০১৭ সালে। সবশেষ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। সঙ্গে ছিলেন শামীম-নীতা দম্পতি। নরসিংদীর যেখানকার রেললাইন থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়েছিল, সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন অসীমা।

ওই সময় শিশুটিকে যাঁরা উদ্ধার করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বোরহান উদ্দীন ও আলম। নরসিংদীতে গিয়ে আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন অসীমা। তখনকার ভিডিও দেখালেন শামীম খান। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, অসীমা সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কাঁদছেন।

যা বললেন উদ্ধারকারীরা

বোরহান উদ্দীন পেশায় ব্যবসায়ী। গত শনিবার মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানান, ওই ঘটনার দিন নরসিংদীর কাছাকাছি খানাবাড়ি স্টেশনমাস্টারের কক্ষে বসে ছিলেন তিনি। একজন রিকশাচালক শিশুটিকে নিয়ে আসেন। সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলতে চাইছিলেন শিশুটির চিকিৎসার জন্য। পরে তিনি চিকিৎসার ভার নেন। নরসিংদী সদর হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলে।

বোরহান উদ্দীন বলেন, সেখানেই শিশুটির সঙ্গে শেষবার দেখা হয় তাঁর। অসীমা যে দুবার নরসিংদী এসেছিলেন, তখন দেখা করা সম্ভব হয়নি।

অসীমা এখন ভালো আছেন—এটাই বোরহান উদ্দীনের তৃপ্তির জায়গা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাচ্চাটার বেঁচে থাকাটাই ছিল অলৌকিক বিষয়। চলন্ত মালবাহী ট্রেন থেকে পড়ে এক পা কেটে গিয়েছিল। মাথায় আঘাত লেগেছিল। তখন তো ছোট দেহটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’

অসীমার গল্প নিয়ে প্রকাশিত প্রথম আলো ছুটির দিনের প্রচ্ছদ

তথ্য দেয়নি অপহরণের সঙ্গে জড়িত রহিমা

শামীম খানের সঙ্গে কথা বলে ও মামলার নথি ঘেঁটে জানা যায়, ওই সময় বেলাল ও তৎকালীন কিশোরী রহিমা (এখন বয়স ৩০ বছর) ছোট্ট শিশুটিকে অপহরণ করেছিলেন। তাঁরা জবানবন্দিতে একবার বলেছেন টঙ্গী থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। আরেকবার বলেছেন, রাজধানীর তেজগাঁও থেকে শিশুটিকে চুরি করেছিলেন তাঁরা।

নথি অনুযায়ী, নরসিংদীর কাছাকাছি খানাবাড়ি রেলস্টেশন পার হওয়ার সময় অসাবধানে কিশোরীর হাত ফসকে শিশুটি নিচে পড়ে যায়। তারপর স্থানীয় লোকজন শিশুটিকে উদ্ধার করেন। পরে বেলাল ও ওই কিশোরী হাসপাতালে গিয়ে শিশুটি তাঁদের সন্তান বলে দাবি করলে অন্যদের সন্দেহ হয়। পরে পুলিশ এসে বেলাল ও ওই কিশোরীকে আটক করে।

শামীম খান জানান, ২০১৭ সালে কারাগার থেকে ছাড়া পান বেলাল। আর গাজীপুরের জাতীয় কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে ওই কিশোরী (রহিমা) ছাড়া পেয়েছেন চলতি বছরের শুরুর দিকে। তবে ২০১৭ সালেই শামীম খান দেশে এসে উন্নয়ন কেন্দ্রটিতে গিয়ে ওই কিশোরীর সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। অসীমার মায়ের বা বেলালের কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি না, সেই চেষ্টা করেন। তবে কিশোরীর কাছ থেকে কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারেননি।

প্রথম আলো কার্যালয়ে অসীমার বাবা শামীম খান। ৬ নভেম্বর, ২০২৪

আশায় আছেন অসীমা

শামীম খান বলেন, ‘আমার মেয়ের বয়স এখন ১৯ বছর হয়েছে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই মেয়ের আসল মাকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি।’

শামীম খান আরও বলেন, ‘অপহরণের সঙ্গে জড়িত কিশোরী জানিয়েছে, অসীমার আসল মায়ের নাম নাজমা। তেজগাঁও স্টেশন থেকে অসীমাকে বেলাল চুরি করেছিল। এর বাইরে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’

‘মেয়ের নরসিংদী যাওয়ার পর তার অনুভূতিটা বুঝতে পারি। অসীমাকে উদ্ধারের সময় আলম নামের যিনি ছিলেন, তাঁর বাড়িতে গেলে অসীমা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। মাকে খুঁজে পেতে চায় বলেও জানায়,’ এমনটাই বলছিলেন শামীম খান।

অসীমা বাংলা বুঝতে পারেন। তবে লিখতে বা পড়তে পারেন না। কিছুটা বলতে পারেন। বাবা শামীম খান জানান, অসীমা প্রথম আলোর মাধ্যমে তাঁর আসল মায়ের চেহারাটা দেখতে চান। তবে সত্যি সত্যি যদি মায়ের খোঁজ পাওয়া যায়, তখন কী করবেন, তা এখনো ভাবেননি বলেও জানান অসীমা।