বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

দূষিত বায়ু আসে ওপার থেকেও

ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার বায়ুদূষণে ৩০ শতাংশ ভূমিকা রাখে সীমান্তের ওপার থেকে আসা দূষিত বায়ু।

উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সারা দিনই ধুলায় ঢাকা থাকে চারপাশ। গত সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ। এই তিন শহরে বায়ুদূষণের যেমন অভ্যন্তরীণ কারণ রয়েছে, তেমনি ভারত থেকে আসা দূষিত বায়ুর কারণেও দূষণ বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকেও দূষিত বায়ু গিয়ে ভারতে দূষণ বাড়াচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে আন্তসীমান্ত বায়ুদূষণের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়—ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় দূষণের ক্ষেত্রে প্রায় ৩০ শতাংশ ভূমিকা রাখে সীমান্তের ওপার থেকে আসা দূষিত বায়ু। বায়ুদূষণ প্রতিরোধে আন্তদেশীয় উদ্যোগ দরকার।

‘বায়ু দূষণমুক্ত করার প্রচেষ্টা: দক্ষিণ এশিয়ার বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা হয়। ঢাকায় বায়ুদূষণের উৎসগুলো কী কী তা একটি লেখচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয় প্রতিবেদনটিতে। এতে বলা হয়, ঢাকায় বায়ুদূষণের উৎস প্রায় ৪ শতাংশ প্রাকৃতিক ও ৬ শতাংশ অভ্যন্তরীণ। প্রায় ২৮ শতাংশ দূষণের উৎস সীমান্তের ওপার থেকে আসা দূষিত বায়ু। দেশের অন্য বিভাগ ও জেলা থেকে আসা দূষিত বায়ুও রাজধানীর বাতাসকে দূষিত করছে। ঢাকার বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে অন্য বিভাগ ও জেলার দূষিত বায়ুর ভূমিকা ৬০ শতাংশের কিছু বেশি।

সীমান্তের ওপার থেকে আসা দূষিত বায়ুর বিষয়ে উদ্যোগ তো পরের কথা, পরিবেশ অধিদপ্তর শহরের ভেতরে ধুলাবালি ও কালো ধোঁয়া কমাতে যদি কার্যকর পদক্ষেপ নিত, তাহলেও মানুষ স্বস্তি পেত।
শাহাদাত হোসেন, রাজধানীর বাসিন্দা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুর মানবিষয়ক গবেষক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের যে অঞ্চলগুলোতে সবচেয়ে বেশি দূষিত বায়ু সৃষ্ট হয়, তার মধ্যে ইন্দো-গাঙ্গেয় অঞ্চলের দেশগুলো রয়েছে। এ অঞ্চলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি। দ্রুত অবকাঠামো নির্মাণ ও নগরায়ণের কারণেও ধুলা বাড়ছে। এ ছাড়া এ অঞ্চলের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখন অনেক বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে রান্না করে ও শীতকালে উষ্ণতা নেয়।

আবদুস সালাম আরও বলেন, বাংলাদেশে যেমন অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ভারত থেকে দূষিত বায়ু প্রবেশ করে, তেমনি গ্রীষ্ম ও বর্ষার মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে দূষিত বায়ু ভারতের কলকাতাসহ অন্যান্য অঞ্চলে যায়। ফলে বায়ুদূষণ রোধে এই অঞ্চলের সব দেশকে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে।

‘দেশের ভেতরে আমরা বায়ুদূষণ কমাতে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করাসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছি। তবে এই প্রতিবেদন থেকে আমরা বুঝতে পারছি, শুধু দেশের ভেতরে উদ্যোগ নিয়ে বায়ুদূষণমুক্ত করা যাবে না।’
নাজমুল আহসান, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা)

দূষিত বায়ু সীমান্ত চেনে না

গবেষকেরা জানান, ভারতের মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাবসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শস্য কাটার পর খেতে আগুন ধরিয়ে গাছ পুড়িয়ে ফেলা হয়। এতে বিপুল পরিমাণে ধোঁয়া তৈরি হয়। একই সঙ্গে দেশটির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ শিল্পকারখানার ধোঁয়া বাতাসে ভেসে সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে আসে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ভারতের পাঞ্জাবের বায়ুদূষণে ৩০ শতাংশ ভূমিকা রাখে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে আসা দূষিত বায়ু। বাংলাদেশের তিনটি শহরে (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা) বায়ুদূষণে ৩০ শতাংশ ভূমিকা ভারত থেকে আসা বায়ুর। বছরের কয়েক মাস আবার উল্টো দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়, যা আবার ভারতে দূষণ তৈরি করে।

মৃত্যু ১ লাখ ৮৬ হাজার

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বায়ুদূষণের বড় কারণ অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২ দশমিক ৫ ও পিএম ১০)। বায়ুদূষণজনিত নানা রোগবালাইয়ে প্রতিবছর ১ লাখ ৮৬ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর জন্য ৬৩ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী ঘরের বাইরের বায়ুদূষণ। আর ৩৭ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী ঘরের ভেতরের দূষিত বায়ু।

প্রতিবেদনটিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নির্মাণকাজের ধুলা, শিল্পকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়াকে বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, রান্না করার জন্য চুলায় জীবাশ্ম জ্বালানির (কাঠ, খড়, গোবর ও পাতা পোড়ানো) ব্যবহারও দূষণ ও মৃত্যু ঘটাচ্ছে।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) নাজমুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের ভেতরে আমরা বায়ুদূষণ কমাতে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করাসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছি। তবে এই প্রতিবেদন থেকে আমরা বুঝতে পারছি, শুধু দেশের ভেতরে উদ্যোগ নিয়ে বায়ুদূষণমুক্ত করা যাবে না।’

বাংলাদেশে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গত ২৮ নভেম্বর বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত ২৯ সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ১৪ জন সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অন্যরা রয়েছেন।

বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরের মধ্যে ঢাকা ছিল দুই থেকে চারের মধ্যে।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্তের ওপার থেকে আসা দূষিত বায়ুর বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া তো পরের কথা, পরিবেশ অধিদপ্তর শহরের ভেতরে ধুলাবালি ও কালো ধোঁয়া কমাতে যদি কার্যকর পদক্ষেপ নিত, তাহলেও মানুষ স্বস্তি পেত।