নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার মূলত দেশের তিন অঞ্চল থেকে সদস্য সংগ্রহ করেছে। সেটা হচ্ছে কুমিল্লা, সিলেট ও বরিশাল অঞ্চল। সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চলে জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণের যে ভিডিও উদ্ধার করা হয়েছে, সেখান থেকে ৩২ জন শনাক্ত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ২০ জনই এই তিন অঞ্চলের।
এর আগে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ বা নিখোঁজ হওয়া ৩৮ তরুণের একটি তালিকা গত বছর ১০ অক্টোবর র্যাব প্রকাশ করেছিল। তাঁরাও মূলত এই তিন অঞ্চলের। তখন র্যাব জানিয়েছিল, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ৫৫ জনের মতো বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়ি ছেড়েছেন। তাঁরা সবাই জামাতুল আনসার সদস্য। র্যাবের প্রকাশ করা ৩৮ জনের ওই তালিকার মধ্যে ১৯ জনের উপস্থিতি দেখা গেছে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের ভিডিওতে।
র্যাব সূত্র জানায়, জামাতুল আনসারের কথিত সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীকে ২৩ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর মুঠোফোনে প্রশিক্ষণের ভিডিওটি পাওয়া গেছে। ওই ভিডিওতে অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণের যে দৃশ্য দেখা গেছে, সেটা পার্বত্য চট্টগ্রামের নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফের (কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) ক্যাম্পে ধারণ করা। ২০২১ সালের শেষ দিক থেকে এ পর্যন্ত কেএনএফের তত্ত্বাবধানে তিনটি ব্যাচে জামাতুল আনসারের ৫৫ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
ভিডিওতে সংগঠনটির আমির আনিছুর রহমান ওরফে মাহমুদ, আনসার আল ইসলামের একসময়ের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা আবদুল্লাহ মায়মুন ওরফে মুমিনকে ফৌজি পোশাক পরা অবস্থায় দেখা গেছে। দুজনের হাতেই অস্ত্র ছিল। ভিডিওতে সিলেট থেকে নিখোঁজ জঙ্গি আবদুর রাজ্জাককে দেখা গেছে। তিনি অস্ত্র-মুখ বাঁধা অবস্থায় প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন। শুরু থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা ছিল, রাজ্জাক আফগানিস্তানে চলে গিয়েছেন। তবে ভিডিওতে ছবি দেখার পর গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছে যে রাজ্জাক দেশেই রয়েছেন।
র্যাব জানিয়েছে, ভিডিওতে চিহ্নিত হওয়া ৩২ জনের মধ্যে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন সালেহ আহমাদ ওরফে সাইহা, সাদিক ওরফে সুমন ওরফে ফারকুন, আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলম ওরফে কয়, বায়েজিদ ওরফে বাইরু ও নিজাম উদ্দিন ওরফে হিরণ। এঁরাসহ পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ভিডিও পর্যালোচনা করে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জামাতুল আনসারের সদস্যরা পুরোপুরি সামরিক কৌশলে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অভিযান ও তদন্তে যুক্ত একটি সূত্র জানায়, চিহ্নিত হওয়া জঙ্গিদের প্রত্যেকেরই একটি করে ছদ্মনাম রয়েছে, যা বমদের নামের সঙ্গে মিল রয়েছে। প্রশিক্ষণকেন্দ্রে যাওয়ার পরপর সবার একটি করে নাম দেয় কেএনএফ।
প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাঁদের নতুন নামেই ডাকা হতো। পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বমদের কিছু ব্যক্তি কেএনএফ প্রতিষ্ঠা করে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কেএনএফের ক্যাম্পে বাঙালি আছে, সেটা আড়াল করতেই জঙ্গিদের এমন ছদ্মনাম দেওয়া হয়। র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, টাকার বিনিময়ে কেএনএফ জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল।
ভিডিও থেকে যাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে
ভিডিওর শুরুতেই দেখা গেছে, সংগঠনটির আমির আনিছুর রহমান অস্ত্র হাতে হেঁটে যাচ্ছেন। ভিডিওর বিভিন্ন অংশে সামরিক পোশাক পরিহিত অবস্থায় প্রশিক্ষণ মহড়ায় জঙ্গি সদস্যদের অংশ নিতে দেখা গেছে। এসব মহড়ায় নেতৃত্বে দেখা গেছে, শিব্বির আহমদ ওরফে কারছে ওরফে হামিদ এবং দিদার ওপরে মাসুম ওরফে চাম্পাইকে।
একটি আভিযানিক মহড়ায় দিদার অস্ত্র উঁচু করে একটি সংকেত দিচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে সবাই অস্ত্র নিয়ে বসে পড়েন। এ সময় শিব্বিরকে ডেকে দিদার কিছু একটা বলেন। এরপরই শিব্বির ওয়াকিটকিতে কিছু একটা বলার পর দাঁড়িয়ে যান। হাত ওপরের দিকে তুলে মাথায় হাত দিয়ে একটি সংকেত দেন। দলের সদস্যরা সামনে এগিয়ে বসে পড়েন। শিব্বির মাটিতে ম্যাপ একে তাঁদের আভিযানিক পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো ভিডিও দেখে যাঁদের পরিচয় শনাক্ত করেছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কুমিল্লার আনিছুর রহমান ওরফে মাহমুদ (জামাতুল আনসারের আমির), মো. দিদার, সালেহ আহমাদ ওরফে সাইহা, সাখাওয়াত হোসাইন ওরফে মাবরুর ওরফে রিসিং, আহাদুল ইসলাম ওরফে মামিত, ইমরান হোসেন ওরফে সাইতল, বায়েজিদ ওরফে বাইরু, আবদুর রাজ্জাক খান ওরফে সিমরাত (সিলেট থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন) ও আল-আমীন ওরফে রামেদ ওরফে চংতের বাড়ি কুমিল্লায়।
ভিডিওতে বরিশাল অঞ্চলের ছয়জনকে চিহ্নিত করেছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা হলেন বরিশালের মাহমুদ ডাকুয়া ওরফে হাকা ও আরিফুর রহমান ওরফে লাইলেন, ঝালকাঠির মিলন তালুকদার ওরফে লামজল ও হাবিবুর রহমান ওরফে মুরা, পটুয়াখালীর শামীম হোসেন ওরফে আবু হুরায়রা ওরফে চামদুর, হোসাইন আহমদ ওরফে রেফামি ওরফে পেদা।
চিহ্নিত হওয়াদের মধ্যে সিলেট অঞ্চলের পাঁচজন রয়েছেন। তাঁরা হলেন সিলেটের শিব্বির আহমদ ওরফে কারছে ওরফে হামিদ, আবদুল্লাহ মায়মুন ওরফে মুমিন, শেখ আহমদ মামুন ওরফে রমেশ ও সাদিক ওরফে সুমন ওরফে ফারকুন এবং সুনামগঞ্জের মো. লোকমান ওরফে ফোরকান ওরফে লংলাই।
চিহ্নিত হওয়া বাকি ১২ জন হলেন ফরিদপুরের জাকারিয়া ও মুহাম্মসদ আবু জাফর ওরফে পিন্টু ওরফে তাহান, মাদারীপুরের আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলম ওরফে কয় ও ইয়াছিন ওরফে আরপি ওরফে চেপা, ঝিনাইদহের আমির হোসেন ওরফে রাফি ওরফে তারপং, মাগুরার আবু হুরায়রা ওরফে সাইচো ওরফে মিরাজ; ময়মনসিংহের শামীম মিয়া ওরফে বাকলাই ওরফে রাজান, নারায়ণগঞ্জের আবদুল্লাহ ওরফে আল-আমীন ওরফে বাহাই ও আক্তার ওরফে আইজল, ঢাকার রায়হান ওরফে সাইনুন, নোয়াখালীর নিজাম উদ্দিন ওরফে হিরণ। এ ছাড়া আরেকজনের নাম মুসাহাবা বলে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তাবে তাঁর ঠিকানা বের করতে পারেনি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভিডিওতে যাঁদের দেখেছি, তাঁদের অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন তাঁদের অবস্থান চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে। বাকিদের পরিচয়ও বের করার চেষ্টা অব্যাহত আছে।’
চিহ্নিত ৩২ জঙ্গির কার বাড়ি কোথায়
১. আনিছুর রহমান ওরফে মাহমুদ, গ্রাম-প্রতাপপুর, থানা/উপজেলা–কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, জেলা–কুমিল্লা
২. মো. দিদার ওরফে চম্পাই, গ্রাম–নিয়ালবাগ, থানা/উপজেলা–সদর দক্ষিণ, জেলা–কুমিল্লা।
৩. সালেহ আহমাদ ওরফে সাইহা, গ্রাম-প্রতাপপুর, থানা/উপজেলা-কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, জেলা-কুমিল্লা।
৪. সাখাওয়াত হোসাইন ওরফে মাবরুর ওরফে রিসিং, গ্রাম-পাহাড়পুর, থানা/উপজেলা-কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, জেলা-কুমিল্লা।
৫. আহাদুল ইসলাম ওরফে মামিত গ্রাম-কালিজিপাড়া, থানা/উপজেলা-বড়ুরা, জেলা-কুমিল্লা।
৬. ইমরান হোসেন ওরফে সাইতল, গ্রাম-ছোট বাবুউরতলা, থানা/উপজেলা-লাকসাম, জেলা-কুমিল্লা।
৭. বায়েজিদ ওরফে বাইরু, গ্রাম-হারং, থানা/উপজেলা-চান্দিনা, জেলা-কুমিল্লা।
৮. আবদুর রাজ্জাক খান ওরফে সিমরাত, গ্রাম–দক্ষিণ, থানা/উপজেলা–কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, জেলা–কুমিল্লা।
৯. আল-আমীন ওরফে রামেদ ওরফে চংতে, গ্রাম–জামমুরা, থানা/উপজেলা–কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, জেলা–কুমিল্লা।
১০. নিজাম উদ্দিন ওরফে হিরন, গ্রাম–মোকিল্ল্যা, থানা/উপজেলা–সোনাইমুড়ী, জেলা–নোয়াখালী।
১১. মাহমুদ ডাকুয়া ওরফে হাকা, গ্রাম–ভবানীপুর, থানা/উপজেলা–বাকেরগঞ্জ, জেলা–বরিশাল।
১২. আরিফুর রহমান ওরফে লাইলেন, গ্রাম–ফরফরিয়া, থানা/উপজেলা–বরিশাল সদর, জেলা–বরিশাল।
১৩. মিলন তালুকদার ওরফে লামজল, গ্রাম–নাচন মহল, থানা/উপজেলা–নলছিটি, জেলা–ঝালকাঠি।
১৪. হাবিবুর রহমান ওরফে মুরা, গ্রাম–কালি আন্দার, থানা/উপজেলা–ঝালকাঠি সদর, জেলা–ঝালকাঠি।
১৫. শামীম হোসেন ওরফে আবু হুরায়রা ওরফে রাফি ওরফে চামদুর, গ্রাম–মধ্য গছানি, থানা/উপজেলা–দশমিনা, জেলা–পটুয়াখালী।
১৬. হোসাইন আহমদ ওরফে রেফামি ওরফে পেদা, গ্রাম–উত্তর লক্ষ্মীপুর, থানা/উপজেলা-দশমিনা, জেলা-পটুয়াখালী।
১৭. আবদুল্লাহ মায়মুন ওরফে মুমিন, গ্রাম–লতিফপুর, থানা/উপজেলা–দক্ষিণ সুরমা, জেলা–সিলেট।
১৮. শিব্বির আহমদ ওরফে কারছে ওরফে হামিদ, গ্রাম–উত্তর ফরিদপটুর, থানা/উপজেলা–দক্ষিণ সুরমা, জেলা–সিলেট।
১৯. শেখ আহমদ মামুন ওরফে রমেশ, গ্রাম–দয়ামির, থানা/উপজেলা–ওসমানীনগর, জেলা–সিলেট।
২০. সাদিক ওরফে সুমন ওরফে ফারকুন, গ্রাম-দয়ামির, থানা/উপজেলা-ওসমানীনগর, জেলা-সিলেট।
২১. মো. লোকমান ওরফে ফোরকান ওরফে লংলাই, গ্রাম–জগদল, থানা/উপজেলা–দিরাই, জেলা–সুনামগঞ্জ।
২২. আমির হোসেন ওরফে রাফি ওরফে তারপং, গ্রাম–বড় বামনদহ, থানা/উপজেলা–কোটচাঁদপুর, জেলা–ঝিনাইদহ।
২৩. জাকারিয়া, গ্রাম–মোহনপুর, থানা/উপজেলা–বোয়ালমারী, জেলা–ফরিদপুর।
২৪. মোহাম্মদ আবু জাফর ওরফে পিন্টু ওরফে তাহান, গ্রাম–হাজীঢাংগী, থানা/উপজেলা–চরভদ্রাসন, জেলা–ফরিদপুর।
২৫. শামীম মিয়া ওরফে বাকলাই ওরফে রাজান, গ্রাম–ঘোমগাঁও, থানা/উপজেলা–ফুলপুর, জেলা– ময়মনসিংহ।
২৬. আবু হুরায়রা ওরফে সাইচো ওরফে মিরাজ, গ্রাম–বড়রিয়া, থানা/উপজেলা–মহম্মদপুর, জেলা–মাগুরা।
২৭. আবদুল্লাহ ওরফে আল–আমীন সরদার ওরফে বাহাই, গ্রাম–র্যালি আবাসিক এলাকা, থানা/উপজেলা–বন্দর, জেলা–নারায়ণগঞ্জ।
২৮. আক্তার ওরফে আইজল, গ্রাম–আমলাপাড়া, থানা–নারায়ণগঞ্জ সদর, জেলা–নারায়ণগঞ্জ।
২৯. রায়হান ওরফে সাইনুন, পূর্ব রসুলপুর, কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা।
৩০. আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলম ওরফে কয়, গ্রাম–পূর্ব স্বরমঙ্গল, থানা/উপজেলা–রাজৈর, জেলা–মাদারীপুর।
৩১. ইয়াছিন ওরফে আরফি ওরফে চেপা, গ্রাম–কালিকাপুর, থানা/উপজেলা–মাদারীপুর সদর, জেলা–মাদারীপুর।
৩২. মুসাহাবা (ঠিকানা পাওয়া যায়নি)।