সরকার আট বছরের মাথায় এসে দেশের গরিব বয়স্ক নারী-পুরুষ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা এবং প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা একটু বাড়াচ্ছে। কোনো শ্রেণির জন্য বাড়াচ্ছে ১০০ টাকা, কোনো শ্রেণির জন্য আবার ৫০ টাকা। শুধু ভাতা নয়, উপকারভোগীর সংখ্যাও একটু বাড়ানো হচ্ছে এবার। অবশ্য অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে বেশির ভাগ শ্রেণির ভাতাই।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে গতকাল সোমবার ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকসূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা প্রমুখ বৈঠকে অংশ নেন বলে জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, বৈঠকে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মিলিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় কয়েকটি শ্রেণির মাসিক ভাতা বৃদ্ধি করার পক্ষে মত দিয়েছেন। বৈঠকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও হিজড়াদের ভাতা বৃদ্ধির পরামর্শ এলেও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। বাজেট চূড়ান্ত করার আগে এ পরামর্শগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে অর্থ বিভাগ।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় বেতনকাঠামোর প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা যখন একলাফে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছিল, গরিব বয়স্ক নারী-পুরুষ এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের ভাতা ছিল তখন মাসিক ৪০০ টাকা করে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তাঁদের ভাতা ১০০ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ৫০০ টাকা এবং এত বছরেও এ ভাতা বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকার হাত দেয়নি।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অঙ্কের হিসাবে প্রতিবারের মতো আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ দেখানো হবে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। যদিও এ বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ শতাংশের নিচেই থাকবে। চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা, যা ছিল জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
বর্তমানে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয় ৫৭ লাখ এক হাজার নারী-পুরুষকে। অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, আগামী বাজেটে ভাতাভোগীর সংখ্যা এক লাখ বাড়ানো হবে। তাঁরা বর্তমানে ৫০০ টাকা করে মাসিক ভাতা পান। এটা বেড়ে হবে ৬০০ টাকা।
এ ছাড়া বর্তমানে ২৪ লাখ ৭৫ হাজার বিধবাকে মাসিক ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। এ শ্রেণিতেও এক লাখ ভাতাভোগী বাড়বে। আর ভাতা বাড়বে ৫০ টাকা। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে বিধবারা ভাতা পাবেন ৫৫০ টাকা করে।
মোট ২৩ লাখ ৬৫ হাজার প্রতিবন্ধী বর্তমানে ভাতা পেলেও আগামী অর্থবছরে এ সংখ্যা ৫ লাখ ৩৫ হাজার বাড়িয়ে করা হবে ২৯ লাখ। তবে ভাতার পরিমাণ ৮৫০ টাকাই রাখা হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভাতা বাড়ানো হচ্ছে না আগামী অর্থবছরে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ভাতা এবার একটু বাড়ছে। অর্থমন্ত্রী এতে ইতিবাচক সায় দিয়েছেন। তবে টিআর, কাবিখা আগের মতোই থাকছে।
বর্তমান অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ১১৫টি বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে নগদ সহায়তা বা ভাতা রয়েছে আটটি শ্রেণিতে। এগুলোয় টাকার পরিমাণ ৪১ হাজার ৮২১ কোটি।
অর্থ বিভাগের তৈরি তালিকায় দেখা যায়, ‘খাদ্যনিরাপত্তা ও কর্মসৃজন কর্মসূচি’ উপশিরোনামের আওতায় টিআর, জিআর, ভিজিডি, ভিজিএফ ইত্যাদি সাতটি বিষয়ে ১৫ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে চলতি অর্থবছরে। এ ছাড়া বৃত্তি বাবদ ছয়টি, নগদ ও খাদ্যসহায়তা–সংক্রান্ত ১৪টি, ঋণসহায়তার দুটি, বিশেষ সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর ১৩টি, বিভিন্ন তহবিল ও কর্মসূচি ৯টি এবং ৩৪টি উন্নয়ন কর্মসূচি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অধিকতর কার্যকর করতে ২০১৫ সালে সরকার পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) মাধ্যমে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএসএস) প্রণয়ন করে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এনএসএসএসের একটি মধ্যবর্তী উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে ৪৬ শতাংশ ভাতাভোগী উপযুক্ত না হয়েও তা নিচ্ছেন বলে তথ্য উঠে আসে। এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক বজলুল হক খন্দকারের গবেষণা রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা খাত নিয়ে। গতকাল তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে এ বিষয়ে তিনি আগে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, মূল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে ধরা হলে এ বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৭ শতাংশের বেশি হবে না। আসলে সরকারের প্রবণতা হচ্ছে এ খাতকে বড় করে দেখানো।
জিডিপির তুলনায় সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেশি দেখাতে প্রতিবারই কিছু খাতকে মোট গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। চলতি অর্থবছরে যেমন অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মচারীদের পেনশন বাবদ ২৮ হাজার ৩৭ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের সুদ সহায়তা বাবদ ৭ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ দুটি ঠিক সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ নয় এবং এর সুবিধাভোগীও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নয়।
এ ছাড়া করোনার কারণে ব্যাংকের সুদ মওকুফ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য সুদ ভর্তুকি বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি ১ হাজার ৯০০ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। অথচ এগুলোকেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বলছে সরকার।
৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে সঞ্চয়পত্রের সুদের হিসাব সামাজিক নিরাপত্তার মোট হিসাব থেকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। গতকালের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাই হয়নি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে ভাতা দেওয়ার আওতা বেড়েছে। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। তবে ভাতার পরিমাণটা একেবারেই প্রতীকী। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ইত্যাদি শ্রেণিতে আট বছর আগের ৫০০ টাকার প্রকৃত মূল্য এখন ৩০০ টাকার একটু বেশি।’
সেলিম রায়হান বলেন, উচ্চ দ্রব্যমূল্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতীকী ভাতা থেকে বেরিয়ে উপকারভোগীদের চলার মতো কার্যকর ভাতা দেওয়া দরকার। একই সঙ্গে কার্যকর একটি তালিকা করা দরকার। পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হিসাবসহ এ–জাতীয় অঙ্ক সামাজিক নিরাপত্তার মোট হিসাব থেকে বাদ দিয়ে দেখানো গেলে সামাজিক নিরাপত্তা বাবদ সরকার কত ব্যয় করছে, সেই চিত্র উঠে আসত।