জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপ

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের ৭৫ শতাংশই বিষণ্নতায় ভুগছেন

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত ৭৫ শতাংশ ব্যক্তিই বিভিন্ন মাত্রায় বিষণ্নতায় ভুগছেন। তাঁদের মধ্যে ২৭ দশমিক ৩ শতাংশের বেশি রোগীর বিষণ্নতা তীব্র মাত্রায় রয়েছে। প্রায় অর্ধেকের বেশি (৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ) রোগীর মৃদু থেকে খুবই তীব্র মাত্রার উদ্বেগ এবং ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ আহত ব্যক্তির স্ট্রেস বা মানসিক চাপের উপসর্গ রয়েছে।

সম্প্রতি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত হয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ৫৫ জনের ওপর জরিপটি চালানো হয়েছে। আহত এই ব্যক্তিদের বয়স ১৪ থেকে ৫০ বছর। এর মধ্যে অর্ধেকের বয়স ২২ বছরের মধ্যে।

জরিপে অংশ নেওয়া আহত ৫৫ জন ব্যক্তির মধ্যে ৩৮ শতাংশ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ। তাঁদের ৬২ শতাংশ অবিবাহিত। আহত এই ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৮ শতাংশ ছাত্র ও ২২ শতাংশ শ্রমিক। মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা নির্ণয়ের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রশ্নমালার মাধ্যমে আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্যের এই চিত্র পেয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, আন্দোলনে আহত হয়ে হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন এক ব্যক্তি এর মধ্যে ভাঙচুর ও উত্তেজিত আচরণ করছিলেন। তখন ওই ব্যক্তির মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনায় রেখে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। তখন শনাক্ত হয় ওই ব্যক্তি আবেগজনিত মানসিক রোগ বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত। মূলত এ সময়ে আহত রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আলোচনায় আসে।

এ ঘটনার পরই মূলত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকেরা আহত ব্যক্তিদের ওপর জরিপটি পরিচালনা করেন। বিষাদ বা বিষণ্নতায়, উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ—এই তিনটি বিষয়ের ওপর গবেষণাটি চালানো হয়। জরিপে উঠে আসে, আহত ব্যক্তিদের ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ স্বাভাবিক অবস্থায় আছেন। ১০ দশমিক ৯ শতাংশ মৃদু বা লঘু, ২১ দশমিক ৮ শতাংশ মাঝারি, ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ গুরুতর বা তীব্র এবং ২৭ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে চরমভাবে বিষাদগ্রস্ততায় রয়েছেন।

আহত ব্যক্তিদের উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তার বিষয়ে গবেষণায় উঠে এসেছে, তাঁদের মধ্যে ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ স্বাভাবিক আছেন। ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ মৃদু বা লঘু, ১২ দশমিক ৭ শতাংশ মাঝারি, ৫ দশমিক ৫ শতাংশ গুরুতর বা তীব্র এবং ২১ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে চরমভাবে উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তার সমস্যা রয়েছে। এ ছাড়া আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ মানসিক চাপ–বিষয়ক সমস্যার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছেন। অন্য ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ মৃদু বা লঘু, ১৮ দশমিক ২ শতাংশ মাঝারি, ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ গুরুতর বা তীব্র এবং ৯ দশমিক ১ শতাংশের মধ্যে চরমভাবে মানসিক চাপের সমস্যা রয়েছেন।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের মধ্যে বড় একটি অংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত। তাঁদের জন্য জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে বিশেষায়িত একটি ইউনিট চালু করা হয়েছে। পুরুষ রোগীদের জন্য ১০ শয্যার আলাদা ওয়ার্ড এবং মহিলা রোগীদের ১০ শয্যার আলাদা ওয়ার্ড রয়েছে। এ ছাড়া বহির্বিভাগেও তাঁদের জন্য বিনা মূল্যে আলাদা চিকিৎসার (কাউন্সেলিং/সাইকোথেরাপি) ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৫ আগস্টের পর ২৯ জনের বেশি মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এই ২৯ জনের মধ্যে ৯ জন নারীও রয়েছেন। মানসিক সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ১২ জন। এর মধ্যে একজনকে দুবার ভর্তি করা হয়েছে।

এই হাসপাতলে মানসিক রোগের চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গণ–অভ্যুত্থানের পর চিকিৎসকের পরামর্শে অথবা সমস্যা গুরুতর হলে বিভিন্ন বয়সী কিছু ব্যক্তি চিকিৎসা গ্রহণ করতে আসছেন। তাঁদের সবাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অথবা হতাহতদের স্বজন। আন্দোলনসংক্রান্ত ঘটনাগুলো তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে। চিকিৎসা গ্রহণকারী এই ব্যক্তিদের প্রায় সবাই বাইপোলার কিংবা পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) রোগে আক্রান্ত।

আহত ব্যক্তিদের নিয়ে গবেষণা জরিপ পরিচালনাকারী দলের সদস্য জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউটের কমিউনিটি ও সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুনতাসীর মারুফ প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনে আহতদের শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসারও প্রয়োজন আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা রোগটি বুঝে উঠতে পারছেন না। এ জন্য এ সমস্যার চিকিৎসা ঠিকভাবে হচ্ছে না। আহতদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য মানসিক সমস্যার প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং এর যথাযথ চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি।