মর্গে থাকা সেই বিবর্ণ পুতুলের পরিচয় জানা গেল, মায়ের জন্মদিনে জন্ম, মৃত্যুও হলো একই দিনে

বেইলি রোডে ভবনের আগুনে প্রাণ গেছে শিশু ফাইরুজ কাশেম জামিরার
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের মেঝেতে শুইয়ে রাখা শিশুটির মরদেহ দেখা গিয়েছিল গতকাল শুক্রবার সকালে। বুকের কাছে সাঁটানো কাগজে লেখা ছিল অজ্ঞাতনামা। মাথায় ঝুঁটি বাঁধা, ধূসর রঙের হাফহাতা গেঞ্জি আর নীল পায়জামা পরা শিশুটির মরদেহ দেখে মনে হচ্ছিল, পড়ে আছে বিবর্ণ এক পুতুল। সেই শিশুর পরিচয় জানা গেছে।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনে মা-বাবার সঙ্গে গিয়েছিল শিশুটি। আগুনে প্রাণ গেছে তার। অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ গেছে তার মা-বাবারও। তিনজনের মরদেহ গতকাল রাতেই শনাক্ত করেছেন শিশুটির নানা।

বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে বেইলি রোডের ওই ভবনে আগুন লাগে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর গতকাল রাত ১০টার দিকে শিশুটির নানা মুক্তার আলম হেলালি ফাইরুজকে শনাক্ত করেন। জানান, তিন বছরের শিশুটির নাম ফাইরুজ কাশেম জামিরা। মায়ের নাম মেহেরুন নিসা জাহান হেলালি (২৪) এবং বাবা শাহজালাল উদ্দিন (৩৪)।

বাবার সঙ্গে ফাইরুজ। আগুনে প্রাণ গেছে বাবা ও মায়ের

আজ সকালে মুঠোফোনে কথা হয় শিশুটির খালা মুক্তারুন নিসা হেলালির সঙ্গে। তিনি বলেন, সকাল ৭টা থেকে তাঁরা মর্গের সামনে অপেক্ষা করেছেন। তিনজনের মরদেহ নিয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাঁরা কক্সবাজারের উখিয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। সেখানে পূর্ব গোয়ালিয়া গ্রামে বোনের শ্বশুরবাড়িতে তিনজনের দাফন সম্পন্ন হবে।

কথা বলার সময় কাঁদছিলেন মুক্তারুন নিসা। তিনি বলেন, ফাইরুজের মা মেহেরুনের জন্মদিন ১৪ সেপ্টেম্বর। একই দিনে ফাইরুজ জন্ম নেয়। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর মা-মেয়ের জন্মদিন উদ্‌যাপন করা হয়। কেউ জানত না তাঁদের মৃত্যুর দিনটিও এক হবে।
গতকাল রাতে মেয়ে, জামাতা ও নাতনির মরদেহ শনাক্তের পর থেকে আহাজারি থামেনি মুক্তার আলম হেলালির। তিনি বলেন, জামাতা শাহজালাল উদ্দিন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ছিলেন। কেরানীগঞ্জের পানগাঁও কার্যালয়ে শুল্ক বিভাগে তিনি কর্মরত ছিলেন। স্ত্রী–সন্তান নিয়ে বাস করতেন বসুন্ধরা রিভারভিউ এলাকায়।  তিন দিনের ছুটিতে ওদের খাগড়াছড়ি বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। মুঠোফোনে দীর্ঘ সময় ওদের খুঁজে না পেয়ে পরে হাসপাতালে যান।

গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শিশুটির মরদেহ দেখার পর এই প্রতিবেদক একাধিকবার ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, রমনা থানার পুলিশ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।  তাঁরা শিশুটির বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। শুধু বলেছিলেন, বেইলি রোডের আগুন লাগার ঘটনায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন শিশুটি।

বেইলি রোডের ওই ভবনের আগুনে এ পর্যন্ত  ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১১ জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁরা কেউ ‘শঙ্কামুক্ত’ নন। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে।

আগুনের ভয়াবহতা ও মৃত্যুর পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন গতকাল বেইলি রোডে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানিয়েছে, ভবনটিতে রেস্তোরাঁ বা পণ্য বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদন ছিল না।

মেয়ে, জামাতা ও নাতনিকে হারিয়ে আহাজারি করছেন মুক্তার আলম হেলালি
শুল্ক কর্মকর্তা শাহ জালাল উদ্দিন, স্ত্রী মেহেরুন নেসা ও তাদের একমাত্র মেয়ে ফাইরুজ কাশেম জামিরা এই পারিবারিক ছবি এখন কেবলই স্মৃতি। ঢাকার বেইলী রোডের আগুনে তাদের মৃত্যু হয়েছে

আগুনের ঝুঁকি ও অনুমোদন না থাকার পরও ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ চলছিল বছরের পর বছর ধরে। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে সেখানে খেতে ভিড় করেছিলেন নগরের বাসিন্দারা। কেউ গিয়েছিলেন শিশুসন্তানদের নিয়ে, কেউ গিয়েছিলেন স্বজনদের নিয়ে, কেউ গিয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে। কারও কারও জীবন চলত ওই ভবনে থাকা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে।