বিশ্লেষণ

আওয়ামী লীগকে জয়ী হতে ‘জোড়’ সাল কেন লাগবে

নওগাঁ নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা ইউনিয়নে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত শোক সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিচ্ছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার
ছবি: সংগৃহীত

খুব দরকারি একটি তথ্য ‘আবিষ্কার’ করেছেন নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাধন চন্দ্র মজুমদার। জোড়-বিজোড় সাল ভোটের রাজনীতিতে কী ধরনের ‘মারপ্যাঁচ’ তৈরি করে, কোনো গবেষক না হয়েও সেটি বের করে ফেলেছেন তিনি। ইতিহাস ঘেঁটে তাঁর আগে দেশের আর কেউ এই কাজটি করতে পারেননি। রীতিমতো সবার চোখ খুলে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, জোড় সালে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ কখনো হারে না।  

মানুষ ভোট দিলে বিজয় না দিলে পরাজয়, এই সহজ হিসাবে না গিয়ে জোড়-বিজোড় সাল খাদ্যমন্ত্রীর কাছে কেন বড় হয়ে উঠল সেটি অবশ্য স্পষ্ট করেননি তিনি।

এর চেয়ে ‘স্বস্তির’ তথ্য (হয়তো তত্ত্বও) সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আর কেউ শোনাতে পেরেছেন কি না, সন্দেহ আছে। সর্বস্তরের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন চাইলে নিশ্চিতভাবেই ‘নিশ্চিন্ত’ অনুভব করতে পারেন।

কারণ, সাধন চন্দ্র মজুমদারের কথার ‘ওজন’ আছে। তিনি সরকারের মন্ত্রী, খাদ্য মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন। ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন দফায় সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন গত সাড়ে তিন বছর ধরে। যদিও চালের দাম তিনি কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছেন তা বাজারে গেলে যে কেউ বুঝবে। মোটা চালের কেজি এখন ৫৫ টাকা।

খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি যেদিন (৭ জানুয়ারি ২০১৯) শপথ নিয়েছিলেন সেদিন রাজধানীর বাজারে মোটা চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ৩৮ থেকে ৪২ টাকা।

তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদ সাধন চন্দ্র মজুমদার যখন মন্ত্রী হন তখন আলোচনা ছিল, তাঁর চাল ব্যবসার অভিজ্ঞতা আছে। ফলে চালের বাজার তিনি ভালো বুঝবেন, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। চালের দামের সঙ্গে নির্বাচনের ফলাফলের সম্পর্ক থাকার কথা বলে থাকেন অনেকে।

দেশের সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনের তফসিল ও ভোটের তারিখ-দুটোই ঠিক করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সংবিধান অনুযায়ী, ‘মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’ এবং ‘মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।

তবে মন্ত্রী চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলেও নির্বাচন কখন করলে ফলাফল পক্ষে আসবে সে হিসাব ঠিকই বের করেছেন। গত শনিবার বিকেলে নওগাঁয় আওয়ামী লীগের এক সভায় তিনি বলেছেন, ‘জোড় সালে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায়। আর বিজোড় সালে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ হেরে যায়। অতীতের সব জোড় সালের নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। সেই নীতি মেনে ২০২৩ নয়, নির্বাচন হবে ২০২৪ সালে।’

এই সরকারের আমলে যে উন্নয়ন হয়েছে, তার এক শতাংশও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে হয়নি—এটিও বলতে ভোলেননি মন্ত্রী। মানুষ ভোট দিলে বিজয় না দিলে পরাজয়—এই সহজ হিসাবে না গিয়ে জোড়-বিজোড় সাল তাঁর কাছে কেন বড় হয়ে উঠল সেটি অবশ্য স্পষ্ট করেননি তিনি।

মন্ত্রী একই সঙ্গে নেতা-কর্মীদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ১৯৭০, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতেছে। ফলে ২০২৩ সাল নয় ২০২৪ সালে ভোট করাই আওয়ামী লীগের জন্য ‘উপযুক্ত’ সময় হবে।

এই বক্তব্য দিয়ে মন্ত্রী একই সঙ্গে দুটি কাজ করেছেন। প্রথমত, নেতা-কর্মীদের জন্য ‘আগাম’ আনন্দের খবর নিয়ে এসেছেন। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বও কিছুটা কমিয়ে দিয়েছেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট করার কথা আগেভাগে জানিয়ে এমনিতেই একটু ‘ঝামেলায়’ আছে নির্বাচন কমিশন। অনেক দল বিষয়টি মানতে না পেরে তাদের ‘বাজে কথা’ শোনাচ্ছে। এমন একটি কঠিন সময়ে অন্তত ভোট কবে হবে সেটি ‘ঠিক করে’ দিয়ে কমিশনকে খানিকটা ‘বিশ্রাম’ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি।

যদিও দেশের সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনের তফসিল ও ভোটের তারিখ—দুটোই ঠিক করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সংবিধান অনুযায়ী, ‘মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’ এবং ‘মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।

সংসদের মেয়াদ হচ্ছে, নির্বাচিত সংসদের প্রথম বৈঠক থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর। সে হিসাবে বর্তমান সংসদের মেয়াদ আছে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু মন্ত্রী যেহেতু বলেছেন, বিজোড় সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিততে পারে না তাই নির্বাচন কমিশনের এখন ‘দায়িত্ব’ হবে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে না করে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারির মধ্যে করা। নির্বাচন কমিশন ভোটের তারিখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বাধীন হলেও বিজোড় সালে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে না—এটিও মাথায় রাখা এখন তাদের বড় দায়িত্ব।

গত কয়েক বছরে দেশে নির্বাচন কমিশনের কাজ ‘সহজ’ করে দিতে বিভিন্ন মহলকে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন ছিল একতরফা, ওই নির্বাচনে ভোট ছাড়াই ১৫৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যান। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল সেই নির্বাচন বর্জন করে। আর ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে গুরুতর অভিযোগ করে আসছে বিরোধী দলগুলো। বিএনপি ভোটে গেলেও গত নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশ্ন উঠেছে। দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘রাতের ভোট’ কথার প্রচলন হয় গত সংসদ নির্বাচন থেকে। জনগণের ভোট—এই বিষয়টি নির্বাচনী রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যাচ্ছে।

ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো