এবার ডেঙ্গু সংক্রমণের পরিস্থিতি ‘উদ্বেগজনক’

এ বছরের প্রথম দুই মাসে ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যু আগের বছরের (২০২৩) প্রায় দ্বিগুণ।

বরগুনা জেলায় গত বছরের (২০২৩) প্রথম দুই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২১। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে এ জেলায় এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা হয়েছে ৮৩। গত বছরে দুই মাসে অবশ্য কোনো মৃত্যু হয়নি ডেঙ্গুতে, এবারও হয়নি।

তবে এবার সংক্রমণের যে পরিস্থিতি, তাকে ‘উদ্বেগজনক’ বলছেন জেলার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ফজলুল হক। তিনি গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘আমার কাছে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কম। আমরা চিকিৎসার বিষয়টি দেখতে পারি। কিন্তু মশা নিধন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি তো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে করতে হবে।’

শুধু বরগুনায় নয়, দেশজুড়েই ডেঙ্গুর সংক্রমণ গত বছরের প্রথম দুই মাসের চেয়ে এবারে দ্বিগুণ হয়েছে। মৃত্যুও প্রায় দ্বিগুণ।

আমার কাছে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কম। আমরা চিকিৎসার বিষয়টি দেখতে পারি। কিন্তু মশা নিধন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি তো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে করতে হবে।
জেলার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ফজলুল হক

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কীটতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকেরা বলছেন, এবারে পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে নাজুক হতে পারে। সংক্রমণ ও মৃত্যু সেই পূর্বাভাস দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অন্তত চারটি আশঙ্কার কথা বলছেন তাঁরা। সেগুলো হলো ঢাকার বাইরে দ্বিতীয়বার ভিন্ন ধরনে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা, মশা নিধনে ঢাকার বাইরে ব্যবস্থার অভাব, ঢাকার বাইরে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা না থাকা এবং অসময়ের বৃষ্টিপাত।

চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৩৯৪। এ সময় ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৭ জন। গত বছরের প্রথম দুই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭৩২। মারা যান ৯ জন। গত বছর ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। দেশে ২০০০ সালে ব্যাপক হারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। এরপর ২২ বছরে যত আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে, তার চেয়ে গত বছর অনেক বেশি হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কীটতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকেরা বলছেন, এবারে পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে নাজুক হতে পারে। সংক্রমণ ও মৃত্যু সেই পূর্বাভাস দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অন্তত চারটি আশঙ্কার কথা বলছেন তাঁরা।

গত বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গু সংক্রমণের উচ্চ হার দেখে বিশেষজ্ঞরা সাবধান করেছিলেন, এ রোগ ব্যাপক হারে ছড়াতে পারে। বাস্তবেও তা-ই হয়েছিল। গত বছর দেশের ডেঙ্গুর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল। এবার এখানেই নতুন বিপদ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

ডেঙ্গুর চারটি ধরন আছে: ডেন ১, ২, ৩ ও ৪। গত বছর দেশে ডেন-২-এ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। চিকিৎসকেরা বলেন, ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার বা নতুন কোনো ধরনে আক্রান্ত হলে সেই রোগীর পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে যায়। ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু বেশি ছড়ালে পরিস্থিতি নাজুক হতে পারে বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিভাগীয় ও জেলা শহরে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো যথেষ্ট আছে। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে বেশি রোগী হলে তা সামলানো কঠিন হয়ে যাবে।’

ঢাকার বাইরের আরেকটি সমস্যা হলো, মশা নিধনের দুর্বল পরিকাঠামো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার ‘ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দেশের ১৫ জেলায় লার্ভা জরিপ করে। সেখানে দেখা গেছে এডিস মশা প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে।

ডেঙ্গুর চারটি ধরন আছে: ডেন ১, ২, ৩ ও ৪। গত বছর দেশে ডেন-২-এ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। চিকিৎসকেরা বলেন, ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার বা নতুন কোনো ধরনে আক্রান্ত হলে সেই রোগীর পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে যায়।

চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. ইমাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মূলত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিই। আর মশা নিধনের বিষয়টি দেখেন ম্যালেরিয়া ও মশকনিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখন থেকেই মশার এবং রোগীর ওপর নজরদারি দরকার, যেটি একেবারেই নেই এখানে। আর দরকার জনগণকে ডেঙ্গু নিধনে সম্পৃক্ত করা। জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলছিলেন, গত বছর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। সেখানে বেশির ভাগ রোগী প্রথমবারের মতো আক্রান্ত হয়েছে। এবার যদি ঢাকার বাইরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে তারা দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হবে। আবার নতুন নতুন রোগীও আক্রান্ত হতে পারে।

আমাদের বিভাগীয় ও জেলা শহরে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো যথেষ্ট আছে। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে বেশি রোগী হলে তা সামলানো কঠিন হয়ে যাবে।
অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ