রিচার্ড নেফিউ
রিচার্ড নেফিউ

নিষেধাজ্ঞাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করি না : রিচার্ড নেফিউ

দুই দিনের সফরে গত রোববার ঢাকায় এসেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিভাগের সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউ। তিনি পররাষ্ট্রসচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দুর্নীতি দমন এবং অর্থ পাচার রোধে সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ঢাকা ছাড়ার আগে গত সোমবার বিকেলে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহীদ এজাজ

প্রশ্ন

প্রথম আলো: মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিভাগের সমন্বয়ক হিসেবে বাংলাদেশে এটা আপনার প্রথম সফর। দুর্নীতি দমন ও অর্থ পাচারের বিষয়ে দুই দেশের সহযোগিতা এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে?

রিচার্ড নেফিউ: দুর্নীতি দমন ও অর্থ পাচারের মতো অভিন্ন সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করছে। আমার এখানে আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ এবং এ দেশের মানুষ কীভাবে দুর্নীতির মুখোমুখি হচ্ছে, সেটা আরও ভালোভাবে জানা। পাশাপাশি এটাও খুঁজে দেখা, বাড়তি কী কী উপায় আছে, যেখানে আমরা বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারি। এই মুহূর্তে সহযোগিতার অবস্থাটা ভালো। তবে এই সহযোগিতা আরও গভীর করার প্রয়োজনীয়তা খুঁজে দেখাও আমার এই সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: অর্থ পাচারের প্রসঙ্গটি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত। আপনার সঙ্গে বৈঠকের পর দুদক সচিব বলেছেন যে এ সমস্যা সমাধানের নতুন উপায় নিয়ে আপনারা আলোচনা করেছেন। নতুন কী কী উপায় নিয়ে আপনাদের মধ্যে কথা হয়েছে?

রিচার্ড নেফিউ: অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত লোকজন নানাভাবে অপরাধকর্মটি করে থাকেন। নতুন অনেক পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া এসব অপরাধী ব্যবহার করেন। নতুন অনেক আর্থিক উপায় যেমন আছে, তেমনি ট্রানজিট পয়েন্টও আছে।

বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমার এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমরা কীভাবে একসঙ্গে তদন্ত করতে পারি, অপরাধীদের খুঁজে বের করতে পারি, সমস্যার সমাধান করতে পারি—এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ দুই দেশের মধ্যে এরই মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সহযোগিতা রয়েছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: দুই দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার কথা আপনি বলছেন। অপরাধ দমনের জন্য প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক আইনি সহায়তা চুক্তি (এমএলএটি) রয়েছে। এমন কোনো প্রক্রিয়ার কথা আপনারা ভাবছেন?

রিচার্ড নেফিউ: আমাদের সহযোগিতার সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডের বিষয়ে এখানে বলতে চাইছি না। প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা আমাদের আছে। এফবিআই এ বিষয়ে কাজ করছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: তার মানে এফবিআই অর্থ পাচারের বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে?

রিচার্ড নেফিউ: সামগ্রিকভাবে অপরাধ দমনে এফবিআই বাংলাদেশের সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করছে, যার মধ্যে অর্থ পাচারের বিষয়টিও জড়িত। ফিনস্যানের (যুক্তরাষ্ট্রের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) সঙ্গে বাংলাদেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কাজ করছে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সরকারিভাবে দুই দেশ কাজ করছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: অর্থ পাচারের সঙ্গে কোনো ব্যক্তির সম্পৃক্ততা খুঁজে পেলে যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে?

রিচার্ড নেফিউ: প্রথম পদক্ষেপটি হচ্ছে অভিযোগ প্রমাণের পর ওই ব্যক্তির সম্পদ জব্দ করা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এটি করা হয়। পাচার হওয়া টাকা যাতে অন্য কোথাও না যায়, সেটি নিশ্চিত করার জন্য তা জব্দ করা হয়। যে দেশ থেকে অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে, সে দেশে যোগাযোগ করা হয়। অর্থাৎ অর্থ জব্দ করার পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটকানো; যে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে, সে দেশে ফেরত পাঠানোসহ সব কটি পদক্ষেপই এর মধ্যে যুক্ত। পুরো বিষয়গুলো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই করা হয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: অর্থ পাচারকারী ব্যক্তি যখন নিজের দেশে অবস্থান করেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়?

রিচার্ড নেফিউ: আমাদের আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষমতা আছে। গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি কর্মসূচির আওতায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকি। যাঁরা দুর্নীতি করেছেন এবং যাঁরা অর্থ পাচারে সহায়তার মাধ্যমে কার্যত দুর্নীতিতে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এটি অতীতে ব্যবহার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করব। সুনির্দিষ্ট কোনো মামলা বা ব্যক্তি নিয়ে আমি মন্তব্য করব না। তবে এটুকু বলব, অতীতে আমরা নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ কাজে লাগিয়েছি, ভবিষ্যতেও তা ব্যবহার করব।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এখানে মনে করা হয় যে নিষেধাজ্ঞাকে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সাধারণত নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে কত সময় প্রয়োজন হয়?

রিচার্ড নেফিউ: আমরা কখনো নিষেধাজ্ঞাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করি না। নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যকে বেছে নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আমরা নিষেধাজ্ঞা দিই না। ব্যক্তির কর্মকাণ্ডকে বিবেচনায় নিয়ে তথ্য–উপাত্ত ও প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যখন কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট পরিমাণে দুর্নীতির অভিযোগ আসে, তখন নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ হয়ে থাকে। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে তাঁর সম্পদ জব্দের পাশাপাশি ভিসায় বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। এখন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। তিনি যে অপরাধে জড়িত, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিলে তখন তাঁর বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাতারাতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় কি না—এমন প্রশ্ন আপনার মনে উঁকি দিতেই পারে। আমরা যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছি, তাঁকে নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করি না। কারণ, আগেভাগে তথ্য প্রকাশিত হলে তিনি তো পার পাওয়ার চেষ্টা করবেন। দায় এড়ানোর সুযোগটা কাজে লাগাবেন। তবে মার্কিন সরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতেই কারও বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: নিষেধাজ্ঞা জারির ক্ষেত্রে সাধারণত আপনারা কত সময় নিয়ে থাকেন?

রিচার্ড নেফিউ: চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘ সময় নেওয়া হয়। একটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের এটা করতে হয় বলে প্রচুর তথ্য–প্রমাণের দরকার হয়। রাতারাতি আমাদের এটা করার সুযোগ নেই। তবে কিছু মামলায় কাজটা খুব সহজেই হয়ে যায়। আবার কোথাও কোথাও বেশ সময় লাগে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এ দেশের জনগণের একাংশ মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। আবার দুর্নীতিবাজদের অর্থ পাচারের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

রিচার্ড নেফিউ: আমরা বলে আসছি, অন্য দেশের মতো আমাদেরও দুর্নীতি দূর করার জন্য এখনো অনেক কিছু করার বাকি আছে। এসবের মধ্যে অন্য দেশ থেকে আমাদের দেশে যে অর্থ আসে, সেটিও অন্তর্ভুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের দুর্নীতি দমন কৌশলের দিকে তাকালে দেখবেন, যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থ পাচারের স্বর্গরাজ্য হতে দেওয়া হবে না—বিষয়টিকে আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনের আওতায় বেশ কটি আইনি পদক্ষেপ আমাদের আছে। আইনি কাঠামোতে যে দুর্বলতা আছে, তা দূর করার জন্য নতুন আইনও বিবেচনায় রয়েছে। আমরা যে ত্রুটিমুক্ত নই, এটা আমরা জানি। আমাদেরও তো একই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

রিচার্ড নেফিউ: আপনাকেও ধন্যবাদ।