জনস্বাস্থ্যের সমস্যা জরিমানা করে দূর করা যায় না

দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আগের যেকোনো বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গুতে মৃত্যুও। জনস্বাস্থ্য–বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, দ্রুত মশকনিধনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য না পেলে দেশজুড়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। হাসপাতালগুলোতে এত রোগী আসতে শুরু করলে বাড়তি চাপ তৈরি হতে পারে স্বাস্থ্যসেবা খাতে। দেশে ডেঙ্গুর সামগ্রিক পরিস্থিতি ও আমাদের করণীয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছে অনিন্দ্য সাইমুম

মুশতাক হোসেন
প্রশ্ন

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বারবার বলছেন, এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের বছরগুলোর তুলনায় মারাত্মক হতে পারে। এমন আশঙ্কার কারণ কী?

মুশতাক হোসেন: এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, আগের যেকোনো বছরের তুলনায় এবার এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের সংখ্যাটি অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, বছরের শুরু থেকে বিরতিহীনভাবে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে, হচ্ছে। এভাবে বছরজুড়ে রোগী শনাক্তের ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। শুধু মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে। এবার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। তৃতীয়ত, সাম্প্রতিক জরিপগুলো বলছে, এ বছর পরিবেশে এডিস মশার লার্ভা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। চতুর্থত, শুধু প্রতিদিন রোগী বাড়ছে, তা–ই নয়; রাজধানী ঢাকার বাইরে বা বড় শহরে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের প্রায় সব জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এসব কারণে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর মধ্যে এবার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি শিশুদের সংখ্যা।
প্রশ্ন

এবার ডেঙ্গুর ধরন (ভেরিয়েন্ট) ডেন-২-এ বেশি আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এমনটা কেন হচ্ছে?

মুশতাক হোসেন: শুধু ডেন-২ নয়, রোগীদের মধ্যে ডেঙ্গুর চারটি ধরন (ডেন- ১, ২, ৩, ৪) শনাক্ত হচ্ছে। দেশে ২০১৯ সালের পর থেকে এমনটা দেখা যাচ্ছে। গত বছর ডেন-৪-এর সংক্রমণ বেশি ছিল। এবার ডেন-২-এর। তবে বাকি ধরনগুলোতেও রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। একসঙ্গে ডেঙ্গুর চারটি ধরন ছড়িয়ে পড়ায় বিপদ বেড়েছে। কেননা, একটি কিংবা দুটি ধরন শনাক্ত হলে সেই একটি বা দুটি মোকাবিলায় মনোযোগ দেওয়া যেত। কিন্তু চারটি ধরন একসঙ্গে শনাক্ত হওয়ায় জটিলতা বেড়েছে। বিশেষ করে একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিরা এতে বেশি ভুগছেন। প্রথমবার একটি ধরনে আক্রান্ত হওয়ার পর আবার অন্য ধরনে আক্রান্ত হলে রোগীর অবস্থা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে ভারতে নতুন একটি ধরন (ডেন-৫) ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। খুব বেশি না ছড়ালেও নতুন ধরনটিতে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীরা হাসপাতালে আসছেন। এ ধরন যদি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে বিপদ আরও বাড়বে।

ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংখ্যা বেড়েই চলছে
প্রশ্ন

এবারই প্রথম দেখা যাচ্ছে, ঢাকার বাইরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এটা কেন হচ্ছে?

মুশতাক হোসেন: অপরিকল্পিত ও অপরিচ্ছন্ন নগরায়ণ বড় কারণ। দেশের সর্বত্র পাকা রাস্তাঘাট, বাড়িঘর হচ্ছে। এটা খুবই ভালো একটি দিক। কিন্তু এসব করতে গিয়ে আমরা অপরিকল্পিত ও অপরিচ্ছন্ন নগরায়ণের দিকে ঝুঁকছি। এতে মশার আবাসস্থল বাড়ছে। ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটছে। আরেকটি কারণ হলো, প্লাস্টিকের ব্যবহার গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। প্লাস্টিকের বোতলে পানি খেয়ে আমরা আশপাশে ফেলে দিচ্ছি। ব্যবহারের পর প্লাস্টিকের ব্যাগ যেখানে-সেখানে ফেলছি। রাস্তাঘাট নির্মাণ, গাড়ির ধোঁয়াসহ বিভিন্ন কাজে পরিষ্কার পানি ব্যবহার করছি। আদতে তা অপচয় হচ্ছে। কৃষিতেও পানির অপচয় হচ্ছে। এসব পানি জমে থাকলে তাতে মশার বংশবিস্তার হচ্ছে। বৃষ্টি ছাড়াও পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা ডিম দিচ্ছে। এসব কারণে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর বাইরেও ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রশ্ন

এবার শিশুদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর খবর বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে পরিসংখ্যান বলছে, পুরুষের তুলনায় নারীর ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বেশি। এর কারণ কী?

মুশতাক হোসেন: আসলে এবার নয়, প্রতিবছরই চারটি শ্রেণি বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। নারী, শিশু, বয়স্ক মানুষ এবং যাঁরা আগে থেকে কোনো রোগে আক্রান্ত, তাঁরাই আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। হাসপাতালেও আসছেন বেশি। কেননা, তাঁদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তুলনামূলক কম। এই চার শ্রেণির মানুষের দিকে বাড়তি নজর রাখতে হবে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু।
প্রশ্ন

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

মুশতাক হোসেন: চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মশার বংশবিস্তারে সহায়ক পরিবেশে থাকা যাবে না। আর প্রতিটা মানুষকে মশারির নিচে আনতে হবে। বিশেষত, যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁরা মশারির নিচে আছেন কি না, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
এ জন্য শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে ডেঙ্গুর প্রাথমিক পরীক্ষা সহজলভ্য করতে হবে। যাঁরই জ্বর হোক, তিনি যেন পরীক্ষা করান। শনাক্ত হলেই মশারির নিচে থাকেন। প্রয়োজনে আলাদা ঘরে আইসোলেশনে থাকেন। এসব নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকেরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে এসবের তথ্য সংগ্রহ করবেন। মানুষকে সচেতন করবেন। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের আলাদা নজরদারিতে বা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। শারীরিক অবস্থা গুরুতর হলে কিংবা রক্তক্ষরণ হলে দ্রুত তাঁদের নিকটস্থ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনতে হবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে হবে। আমরা যদি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা জেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের মশারির নিচে রাখতে পারি, তাঁদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে পারি, সেখানেই প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারি, তাহলে বড় শহরের হাসপাতাল কিংবা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় রোগীর চাপ অনেকটা কমবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশকনিধনের পাশাপাশি রোগীদের মশারির নিচে নজরদারিতে রাখা সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে মৃত্যুঝুঁকি অনেকটাই কমে আসবে। চিকিৎসা খাতে লোকবলের অভাব রয়েছে। এটা মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে।

প্রশ্ন

এই যে নজরদারি বা পর্যবেক্ষণের কথা বলছেন, এটা কী উপায়ে করা যাবে?

মুশতাক হোসেন: নজরদারি বা পর্যবেক্ষণ করতে হবে তিনটি পর্যায়ে। প্রথমত, রোগীর প্রতি নজর রাখা। এ বিষয়ে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে। দ্বিতীয়ত, মশার বিস্তার রোধ। এ জন্য প্রতিদিন জরিপ করতে হবে। এলাকাভিত্তিক জরিপ হবে। তৃতীয়ত, মশকনিধনে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে, সেসবের প্রতি নজর রাখা বা পর্যবেক্ষণ করা। এসব রাসায়নিক আসলে কার্যকর কি না, সেটা যাচাই করা। নজরদারি না করে রাসায়নিক ছিটিয়ে কোনো লাভ হবে না।

প্রশ্ন

এবার ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হওয়ার পরও আফটার শকে ভুগছেন অনেকেই। এর কারণ কী?

মুশতাক হোসেন: এটার বড় কারণ ডেঙ্গু পরিস্থিতি সঠিকভাবে বুঝতে না পারা। জ্বর সেরে গেলেই অনেকে মনে করেন, তাঁরা সুস্থ হয়ে গেছেন; কিন্তু এমনটা নয়। জ্বর সেরে যাওয়ার পরও বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই জ্বর সেরে যাওয়ার অন্তত সাত দিন পর্যন্ত রোগীকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। জটিলতা দেখা দিলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে আফটার শকে ভোগার আশঙ্কা কমে আসবে।

প্রশ্ন

ঢাকাসহ সারা দেশের মশকনিধন কার্যক্রম নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট? এ ক্ষেত্রে আরও কী কী করা যেতে পারে?

মুশতাক হোসেন: আসলে এখন পর্যন্ত যা হচ্ছে, কোনোটাই পর্যাপ্ত নয়। চিকিৎসা বলেন আর মশকনিধন—কোনোটাই পর্যাপ্ত নয়। জনস্বাস্থ্য–সংক্রান্ত জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করে একযোগে কাজ করতে হবে। এখন বিচ্ছিন্ন কাজ হচ্ছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় নিয়োজিত জনশক্তি খুবই অপর্যাপ্ত। সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে মাত্র ১৩ জন কর্মী সকাল-বিকেল ভাগ করে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। এতে কাজ হবে না। আর শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে মশা নিধন করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহযোগিতা করতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে এডিস মশার লার্ভা পেলে জরিমানা করা হচ্ছে। জরিমানা করা নেতিবাচক একটি উদ্যোগ। এতে মানুষ মোটেও সচেতন হবে না। বরং সচেতন করতে হলে ডেঙ্গু মোকাবিলার উদ্যোগে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সাধারণ মানুষ, সরকার—সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনস্বাস্থ্যের সমস্যা জরিমানা করে দূর করা যায় না। বরং মানুষের সম্পৃক্ততা সমাধানের কার্যকর কৌশল। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে মশকনিধন ও ডেঙ্গু রোগীর বিষয়ে এলাকাভিত্তিক জরিপ বা পর্যবেক্ষণের বিকল্প নেই। আইইডিসিআরের এ বিষয়ে সক্ষমতা রয়েছে। এ সক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে হবে।

প্রশ্ন

বর্তমান পরিস্থিতি ‘জনস্বাস্থ্য–সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা’ জারির একটা দাবি উঠেছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?

মুশতাক হোসেন: আসলে এটা দাবির বিষয় নয়। জরুরি অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তা মোকাবিলায় সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। করোনা মহামারির সময় সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছি। এ উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। এ ছাড়া প্রতিবেশী ভারতের কলকাতা-দিল্লিতে মশকনিধন ও ডেঙ্গু মোকাবিলায় বড় ধরনের সফলতা পেয়েছে। সেই উদাহরণ চোখের সামনেই আছে। সেসব অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। একই আবহাওয়া ও জলবায়ুর দেশ ভারত সফল হতে পারলে আমরা পিছিয়ে থাকব কেন?

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

মুশতাক হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।