কর্ণফুলী টানেল
কর্ণফুলী টানেল

কর্ণফুলী টানেল: দিনে ব্যয় ৩৭ লাখ, আয় ১০ লাখ

  • প্রতিদিন গাড়ি চলার কথা ১৮ হাজার ৪৮৫টি। চলছে ৩ হাজার ৯১০টি।

  • দিনে ব্যয় ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার, আয় ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।

  • গত বছরের ২৯ অক্টোবর চালু হয় টানেল।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ বা টানেল খুব একটা ব্যবহার করছেন না গাড়িচালকেরা। চালুর পর প্রথম বছরে টানেল দিয়ে যেখানে প্রতিদিন সাড়ে ১৮ হাজার গাড়ি চলাচল করার কথা ছিল, সেখানে চলছে ৪ হাজারের কম। টোল থেকে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা আয় হলেও রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন খরচ হচ্ছে ৩৭ লাখ ৪৬ লাখ টাকা। এক বছরে আয়-ব্যয়ের ব্যবধান দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

টানেলের ভেতর দিয়ে যানবাহন চলাচলের এমন হতাশাজনক চিত্র আগামী পাঁচ বছরেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা, মূলত কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে সারা দেশে পণ্য আনা-নেওয়ার প্রধান মাধ্যমে হওয়ার কথা ছিল এই টানেল। একই সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ সাগরপাড়ে শিল্পায়ন হলেও টানেলে গাড়ি চলাচল বাড়ত।

তবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর বাস্তবায়ন তিন বছর পিছিয়ে গেছে। ২০৩০ সালের আগে এই বন্দর চালু হচ্ছে না। আবার দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে যেসব শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার কথা ছিল, সেগুলোও এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

২০৩০ সালে মাতারবাড়ী বন্দর চালুর আগ পর্যন্ত গাড়ি চলাচল প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়বে না।

এ অবস্থায় টানেল দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গাড়ি চলাচলের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। গত বছরের ২৯ অক্টোবর যাতায়াতের জন্য টানেল উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর আগের দিন তৎকালীন প্রধান শেখ হাসিনা এটির উদ্বোধন করেছিলেন।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ভবিষ্যতে যদি মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর চালু হয়, কক্সবাজার ও আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো যদি হয়, তাহলে হয়তো টানেলের প্রয়োজন হতো। এগুলো তো হয়নি। এখন নিশ্চিতভাবে বলা চলে, এ সময়ে টানেল করার প্রয়োজন ছিল না। যদি গাড়ি না চলে, আয় না হয়, তাহলে এটা করার উদ্দেশ্য কী হতে পারে? একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাহবা কুড়ানোর। আরেকটি কারণ হতে পারে, দুর্নীতি। এখন আমরা আলোচনা করছি, এটি দিয়ে ট্রাফিক (গাড়ি) ও রেভিনিউ (রাজস্ব) কীভাবে বাড়ানো যায়।’

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের মূল দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। চীনা ঋণ ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এই টানেল তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। পরে ব্যয় বেড়ে হয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে।

চলার কথা ১৮৫০০ গাড়ি, চলছে ৩৯১০টি

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০২৪ সালে প্রতিদিন গড়ে ১৮ হাজার ৪৮৫টি গাড়ি চলার একটি পূর্বাভাস দিয়েছিল; কিন্তু বাস্তবে তা-ও পূরণ হচ্ছে না।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত গাড়ি চলেছে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি। অর্থাৎ প্রতিদিন গাড়ি চলছে ৩ হাজার ৯১০টি করে। পূর্বাভাসের চেয়ে ১৪ হাজার ৫৭৫টি কম।

প্রত্যাশা অনুযায়ী গাড়ি না চলার কারণে বড় ধাক্কা এসেছে আয়ের ক্ষেত্রে। এখন পর্যন্ত টানেল থেকে টোল আদায় হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। প্রতিদিন আয় হয়েছে মাত্র ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। দিনে ব্যয় ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। বছরে ব্যয় হচ্ছে ১৩৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলামের মতে, টানেল নির্মাণ হচ্ছে একটি দূরদর্শী প্রকল্প। তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, চালুর প্রথম পাঁচ বছর টানেল সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যবহার হবে না। তাই এ সময়ে টোলের আয় দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত খরচ মেটানো যাবে না। এটির পরিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য মিরসরাই শিল্পনগর থেকে আনোয়ারা-বাঁশখালী হয়ে পেকুয়া-মাতারবাড়ী-কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করতে হবে। এই এলাকাজুড়ে শিল্পায়ন, পর্যটন ও আবাসন এলাকা গড়ে উঠবে ভবিষ্যতে। তবে সময় লাগবে। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং মিরসরাই শিল্পাঞ্চল চালু হলে টানেলের ব্যবহার আরও বাড়বে। এটা আগামী ১০০ বছর ধরে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখবে। সেদিক থেকে এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নেই তা বলা যাবে না। তবে প্রকল্পের খরচ নিয়ে প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন।