বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো কঠোর পদক্ষেপও নিয়েছিল তারা; যা দুই দেশের সরকারের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা ও অস্থিরতা তৈরি করেছিল। এবার ঢাকায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু অকপটে তা স্বীকারও করেছেন। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন কিংবা মানবাধিকার পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হলো-এসব বিষয় পাশে সরিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কথা বেশ স্পষ্ট করেই জানিয়ে গেছেন তিনি।
এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আপাতদৃষ্টে নমনীয় মনে হতে পারে। দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ডোনাল্ড লুর এবারের সফরের মধ্য দিয়ে এটা প্রতিফলিত হয়েছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে মনোযোগী যুক্তরাষ্ট্র। অতীতের তিক্ততা সরিয়ে রেখে নতুন করে সম্পর্ক জোরদার করতে চায় দেশটি। সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এখন যেসব বিষয় দেশটির অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে, তার শীর্ষে রয়েছে অর্থনীতি। সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ডোনাল্ড লুর আলোচনাতেও অর্থনীতির বিষয়গুলো এসেছে।
ডোনাল্ড লুর এবারের সফর নিয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, এমনিতেই এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে নিজেদের অস্বস্তির কথা গোপন করে না যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের চার মাস পর ১৪ মে দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন ডোনাল্ড লু। এর আগে গত বছর নির্বাচনের আগে দুবার (জানুয়ারি ও জুলাই মাসে) বাংলাদেশ সফর করেন তিনি।
ডোনাল্ড লুর এবারের সফর নিয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, এমনিতেই এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে নিজেদের অস্বস্তির কথা গোপন করে না যুক্তরাষ্ট্র। কয়েক বছর ধরেই চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। এখন চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সমমানের চীনা মুদ্রার ঋণ নিয়ে আলোচনা করছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র ও সুশাসনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মতপার্থক্য আরও বেড়ে যাক, এটি চায় না যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া ভূরাজনীতি এবং ভূ-অর্থনীতির নতুন প্রেক্ষাপটও আগের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার বিষয়টিকে বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টি এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
এবার সরকারি ও বেসরকারি নানা পর্যায়ে ডোনাল্ড লুর আলোচনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রসঙ্গটি ঘুরেফিরে এসেছে। গত মঙ্গলবার নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জানা-বোঝার চেষ্টা করেছেন। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত শোনার পর এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। এমনকি শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে একপর্যায়ে ডোনাল্ড লু মন্তব্য করেন, বাংলাদেশ সে ধরনের কোনো আর্থিক সংকটে যাতে না পড়ে, সেটাই চায় যুক্তরাষ্ট্র।
দুই দেশের সম্পর্কের পরিসরটা অনেক বড়। সম্পর্কের সবটাই কিন্তু গণতন্ত্র আর সুশাসনে আবদ্ধ নয়। দুই দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্রে অর্থনীতি যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ওয়াশিংটন বেশ কিছুদিন ধরেই বলছে। অর্থনীতির বিষয়গুলোর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, করনীতির সংস্কার, বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশের বিষয়গুলো চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত যখন বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন, বুঝতে হবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও তাঁদের বিবেচনায় রয়েছেবাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) পরিচালক এম হুমায়ুন কবির
সফরের প্রথম দিনে ডোনাল্ড লু প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন। সেখানে আলোচনায় বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতির বিষয়টি নিয়ে তিনি কথা বলেন। সেই আলোচনায় তিনি জানতে চেয়েছেন, যেসব মার্কিন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা করছে, তাদের অর্থছাড়ে কেন দেরি হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনো চাপ তৈরি করেননি বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে। ওই আলোচনায় বাংলাদেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত থাকার বিষয়টিও বলেছেন তিনি।
সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু দুই দেশের ভবিষ্যৎ সহযোগিতার প্রসঙ্গ টেনে আর্থিক সুশাসন ও দুর্নীতি দূর করার ক্ষেত্রে কাজ করার বিষয়ে তাঁর দেশের আগ্রহের কথা এই প্রতিবেদককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন। অন্যদিকে সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, দুই দেশের জনগণের মধ্যে পুনরায় আস্থা স্থাপনের চেষ্টা করছেন তিনি।
ডোনাল্ড লুর সফর কী বার্তা দিয়ে গেল, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) পরিচালক এম হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের পরিসরটা অনেক বড়। সম্পর্কের সবটাই কিন্তু গণতন্ত্র আর সুশাসনে আবদ্ধ নয়। দুই দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্রে অর্থনীতি যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ওয়াশিংটন বেশ কিছুদিন ধরেই বলছে। অর্থনীতির বিষয়গুলোর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, করনীতির সংস্কার, বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশের বিষয়গুলো চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত যখন বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন, বুঝতে হবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও তাঁদের বিবেচনায় রয়েছে।