কর্মবিরতির অংশ হিসেবে কলা ভবনের মূল ফটকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি
কর্মবিরতির অংশ হিসেবে কলা ভবনের মূল ফটকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি

সর্বজনীন পেনশন: সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়নি, শিক্ষক আন্দোলন চলবে

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অচলাবস্থা নিয়ে শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের গতকাল বৃহস্পতিবারের নির্ধারিত বৈঠক শেষ পর্যন্ত হয়নি। বৈঠকটি স্থগিত করার কারণ হিসেবে মন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ততার কথা বলা হয়েছে। এখন ঠিক কবে নাগাদ এই বৈঠক হতে পারে, সে ব্যাপারেও সরকারের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় জানানো হয়নি শিক্ষকনেতাদের।

সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচির বিরুদ্ধে আন্দোলনে থাকা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকনেতারা আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠকের অপেক্ষায় থাকার কথা বলছেন। তাঁরা আশা করছেন, শিগগিরই সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে তাঁদের এই বৈঠক হবে। আলোচনা করেই একটা সমাধানে যেতে চান তাঁরা।

আমরা বর্তমান সরকারের পক্ষেই সব সময় কথা বলেছি। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার আলোচনার মাধ্যমে আমাদের দাবি মেনে নেবে।
মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া, মহাসচিব, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন

একই সঙ্গে দাবি আদায়ে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বাত্মক কর্মবিরতি অব্যাহত রেখেছেন। এতে ক্লাস, পরীক্ষা হচ্ছে না। টানা পাঁচ দিনের কর্মবিরতিতে অচল এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগেই শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে রয়েছেন সরকার-সমর্থকেরা।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের ভেতরে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অপমান করার জন্য পেনশনের প্রত্যয় কর্মসূচি হাজির করেছে। কিন্তু আমরা বর্তমান সরকারের পক্ষেই সব সময় কথা বলেছি। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যয় কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন বাতিলের আমাদের দাবি মেনে নেবে।’

এই শিক্ষকনেতা গত বুধবার জানিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাঁদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে গতকাল বৈঠক করতে চেয়েছিলেন। এই বৈঠকের দিনে সকালে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া টেলিফোন করে ওই বৈঠক স্থগিত রাখার কথা জানান। সে ক্ষেত্রে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ততার বিষয়কে কারণ হিসেবে বলা হয়।

একই সঙ্গে দাবি আদায়ে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বাত্মক কর্মবিরতি অব্যাহত রেখেছেন। এতে ক্লাস, পরীক্ষা হচ্ছে না। টানা পাঁচ দিনের কর্মবিরতিতে অচল এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগেই শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে রয়েছেন সরকার-সমর্থকেরা।

এদিকে সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্দেশনা না পাওয়ায় নির্ধারিত বৈঠকটি হয়নি। তবে বৈঠক বা আলোচনা হবে। এ ছাড়া সরকার সময় নিতে চাইছে বলেও ওই সূত্রগুলো বলছে।

আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের বেশি সময়ের শাসনে শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে একযোগে এতসংখ্যক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে পড়ার নজির নেই বলে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন। তবে সরকারের একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, যেহেতু বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিতে সরকার-সমর্থকেরা নেতৃত্বে রয়েছেন এবং তাঁরাই এই আন্দোলন করছেন; ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না। এমন ধারণা সরকারের ভেতরে রয়েছে।

একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই আন্দোলন কতটা প্রভাব ফেলতে পারে বা তাঁরা আন্দোলন কত দূর এগিয়ে নিতে পারেন, সেটিও পর্যবেক্ষণ করার কথা বলছেন সরকারের সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ। একজন মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, আলোচনায় দর-কষাকষি প্রশ্নের আন্দোলনের প্রভাবটাও সরকারের বোঝা প্রয়োজন। এসব কারণে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার প্রশ্নে সময় নেওয়া হতে পারে।

বর্তমান ব্যবস্থায় একজন অধ্যাপক মাসে ৪৫ হাজার ৭৯০ টাকা পেনশন পান। এ জন্য তাঁদের বেতন থেকে কোনো টাকা কাটা হয় না। সর্বজনীন পেনশন নিয়ে গঠিত মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন ব্যবস্থায় ৩০ বছর বয়সে যোগ দিয়ে ৬৫ বছর বয়সে অবসর নিলে মাসে মাসে বেতন থেকে টাকা কাটার পর পেনশন পাওয়া যাবে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ব্যাপারে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব কোনো ছাড় দিতে রাজি নন। এরপরও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই পেনশনের প্রত্যয় কর্মসূচিতে কোনো অস্পষ্টতা থাকলে কর্তৃপক্ষ তা স্পষ্ট করছে। এর সঙ্গে সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি থাকলে এই কর্মসূচির আওতাতেই সেটা নিরসনের চেষ্টা থাকবে। এগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিষয় উল্লেখ করে ওই মন্ত্রী এ-ও বলেন, এখন সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে আলোচনা প্রয়োজন।

যদিও সরকারের মধ্যে এসব নানা আলোচনা রয়েছে। শিক্ষকনেতা নিজামুল হক ভূঁইয়া বলছেন, তাঁদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর যোগাযোগ আছে এবং একটা সমাধানের আশা তাঁরা করছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অচলাবস্থা ও শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট একজন মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারের ভেতরে কাজ চলছে। সমাধানের পর বিষয়গুলো স্পষ্ট হবে।

আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চাইছেন। একই সঙ্গে দাবি না মানা পর্যন্ত কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার কথা বলছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিনাত হুদা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সমাধানের অপেক্ষায় রয়েছেন।

অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ অভিযোগ করেছেন, শিক্ষকদের আন্দোলনে ভর করছে বিএনপি। গতকাল ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সাপ্তাহিক গণবাংলা ও বাংলাদেশ স্বাধীনতা পরিষদ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনে গতি হারিয়ে বিএনপি এখন পরজীবী দল হয়ে গেছে। তারা এখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ভর করে, শিক্ষকদের আন্দোলনে ভর করে।

শিক্ষকদের দাবি

বর্তমান ব্যবস্থায় একজন অধ্যাপক মাসে ৪৫ হাজার ৭৯০ টাকা পেনশন পান। এ জন্য তাঁদের বেতন থেকে কোনো টাকা কাটা হয় না। সর্বজনীন পেনশন নিয়ে গঠিত মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন ব্যবস্থায় ৩০ বছর বয়সে যোগ দিয়ে ৬৫ বছর বয়সে অবসর নিলে মাসে মাসে বেতন থেকে টাকা কাটার পর পেনশন পাওয়া যাবে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা। কিন্তু আনুতোষিক বা গ্রাচ্যুইটি বাবদ এককালীন ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা নতুন ব্যবস্থায় পাওয়া যাবে না। এই টাকা পেনশন তহবিল বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে যে মুনাফা পাওয়া যায়, তা যোগ করলে বর্তমান ব্যবস্থায় পেনশন দাঁড়ায় মাসে ১ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এখানে সুবিধা কমার অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষকনেতারা। কর্তৃপক্ষ বলছে, ১ জুলাই থেকে যাঁরা যোগ দেবেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে।

শিক্ষকনেতারা বলছেন, তাঁদের দাবি তিনটি: ১. সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন বাতিল। ২. সুপার গ্রেডে (জ্যেষ্ঠ সচিবরা যে গ্রেডে বেতন পান) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং ৩. শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো। এসব দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা বলছেন তাঁরা।