বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সংবাদ সম্মেলন, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সংবাদ সম্মেলন, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব

অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণা-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সরকারের স্পষ্ট বার্তা চায় শিক্ষক নেটওয়ার্ক

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের ‘অসহিষ্ণু, আক্রমণাত্মক এবং নৈরাজ্যবাদী জমায়েত ও হামলা’ দেখে উদ্বিগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের এ সংগঠন অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণা-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে স্পষ্ট বার্তা চেয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের নির্মোহ ভূমিকা ও আশু পদক্ষেপ আশা করেছে তারা।

আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে শিক্ষক নেটওয়ার্ক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বরাবর লেখা একটি খোলাচিঠি পড়ে শোনানো হয়। আজ বা আগামীকাল রোববার চিঠিটি প্রধান উপদেষ্টাকে পাঠানো হবে এবং স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা, আইন, ধর্ম ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টাকেও অনুলিপি পাঠানো হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

খোলাচিঠি পড়ে শোনান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন। ড. ইউনূসকে উদ্দেশ করে চিঠিতে বলা হয়, ‘পরিতাপের বিষয়, অভ্যুত্থানের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের অসহিষ্ণু, আক্রমণাত্মক ও নৈরাজ্যবাদী জমায়েত আমরা লক্ষ করছি। সেসব জমায়েত থেকে অপছন্দের গোষ্ঠী ও দলের বিরুদ্ধে শুধু হিংসাত্মক কথাবার্তাই বলা হচ্ছে না, ক্ষেত্রবিশেষে হামলাও চালানো হচ্ছে।’

সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন হামলা ও হত্যার ঘটনা তুলে ধরা হয় চিঠিতে। এসব ঘটনা দীর্ঘদিন সমাজের মধ্যকার নানা অমীমাংসিত সমস্যা ও গণতন্ত্রহীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, এভাবে চললে নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধের অভাব তীব্রতর হবে এবং সংকট উত্তরণে সরকারকে আরও বেগ পেতে হবে। এই ক্রান্তিকালে বর্তমান সরকারের নির্মোহ ভূমিকা পালন ও আশু পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। যাঁরা এসব ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচার করছেন এবং বিভিন্ন পরিচয় ও সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর বা নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করছেন, তাঁদের থামাতে হবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, সরকার বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেরাই যদি এসব হস্তক্ষেপকারীর সাহস জুগিয়ে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতার ভয় দেখিয়ে কোনো গোষ্ঠীর কথা পালনে বাধ্য করে, তাহলে এত দামে কেনা জুলাই অভ্যুত্থানের কোন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন হলো? সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসতে হবে, তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ কীভাবে নিশ্চিত করবে। অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। সহিংস জমায়েতের সংঘবদ্ধ হিংস্রতা থেকে ভিন্নমত বা সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার রক্ষায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে, তা–ও সুস্পষ্ট করতে হবে।

স্পষ্ট বার্তা দাবি

চিঠি পড়ে শোনানোর পর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকেরা বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। এক প্রশ্নের জবাবে গীতি আরা নাসরিন বলেন, ‘কারও বিশ্বাস নিয়ে অসম্মান, ঘৃণাবাচক শব্দ ব্যবহার, আক্রমণ—এভাবে কোনো সহনশীল সংস্কৃতি নির্মাণ করা যায় না। সবাই যাতে মর্যাদা পান, সেই চিন্তা সবাইকেই করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। নীতিনির্ধারক ও উপদেষ্টামণ্ডলীর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বার্তা আসতে হবে। এগুলো যে গ্রহণযোগ্য নয়, সে বিষয়ে আমরা পরিষ্কার বার্তা চাইছি।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, ‘সমাজে অসহিষ্ণু কণ্ঠস্বরগুলো জোরালো হতে দেখা যাচ্ছে। জাতি, ধর্মীয় পরিচয়, জাতিসত্ত্বা ও ভিন্ন রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর থামিয়ে দিতে বিভিন্ন আধিপত্যশীল কণ্ঠস্বর উঠে আসছে। ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। এসব বিষয়ে আমরা সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ চাই। এত রক্তপাত হলো। দেশের মাথা ও ঘাড় থেকে এত বড় জগদ্দল পাথর নামানো হলো। তারপরও যদি একই রকমের ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর জায়গায় চলে যাই, তাহলে কেমন হলো?’

সাঈদ ফেরদৌস আরও বলেন, সমাজের যে প্রান্ত থেকে অসহিষ্ণু কথাবার্তা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে সরকারকে প্রয়োজনে আলাপ-আলোচনা করতে হবে, শক্ত হাতে দমনের প্রয়োজন হলে শক্ত হাতে দমন, আইন প্রয়োগের প্রয়োজন হলে আইন প্রয়োগ করতে হবে। দল-মত-পথনির্বিশেষে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সাঈদ ফেরদৌস বলেন, ‘রাজনীতির বিরুদ্ধে আমরা নই। কিন্তু আমরা অবশ্যই রাজনীতির নামে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ ও দখলদারত্বের বিরুদ্ধে।’

অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের কোনো নমুনা দেখা যাচ্ছে কি না, প্রধান উপদেষ্টার কাছে এমন প্রশ্ন রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী। তিনি বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তক সংস্কারের কাজে কিছু শিক্ষক কাজ করছেন। তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কিন্তু তাঁদের ধর্মবিদ্বেষীসহ নানা ট্যাগ দিয়ে বাদ দিতে বলা হচ্ছে। এ ধরনের দাবি সমাজে অস্থিরতা ও সংঘাত তৈরি করছে।’

ছাত্ররাজনীতি প্রশ্নে রুশাদ ফরিদী বলেন, ‘ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি কোনো সমস্যা নয়, যতক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশে আইনের শাসন, জবাবদিহি ও ন্যায্য বিচার থাকে। আইনের শাসন থাকলে কেউ অন্যায় সুবিধা নিতে পারে না, হলের আসন দখল করতে পারে না। এগুলো ছাত্ররাজনীতি নয়। ছাত্রলীগের রাজনীতি ছাত্ররাজনীতি নয়, এটা আমাদের খুব পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্বৈরাচার সরকারের পতনের মূল ভিত্তি হচ্ছে ছাত্ররাজনীতি। রাজনীতি অবশ্যই চলবে। কিন্তু সেটা হতে হবে কল্যাণকেন্দ্রিক।’