১৮ বছরে হাসপাতালের জীবন আর শেষ হয়নি রাশেদার। স্প্লিন্টারের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে মাঝেমধে৵ জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন।
গ্রেনেড হামলায় মৃত ভেবে রাশেদা আক্তারকে মরদেহের সঙ্গে রাখা হয়েছিল। নিহত ব্যক্তিদের আনা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। একজনের সন্দেহ হওয়ায় রাশেদাকে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে সেই চিকিৎসা যে আর কোনো দিন শেষ হবে না, সেটি তিনি জানতেন না। তখন থেকে গত ১৮ বছরে একবারের জন্যও স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারেননি রাশেদা।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন রাশেদা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম বিস্ফোরিত গ্রেনেড আমার আর আইভি আন্টির পায়ে লেগেছিল। ঢাকা মেডিকেলে মরদেহের ভেতর আমাকে প্রথম জীবিত আবিষ্কার করেছিলেন চায়না নামের একজন। এরপর সাবের ভাইয়ের গাড়িতে করে কয়েকটি হাসপাতালে নেওয়া হয়।’
শরীরভর্তি শত শত স্প্লিন্টারের যন্ত্রণার কথা কী বলব। ব্যথা শুরু হলে মাথা ঠিক থাকে না। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে জিনিসপত্র ভাঙচুর করি। গাড়ির হর্নের শব্দে কান থেকে রক্ত বের হয়।রাশেদা আক্তার, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ভুক্তভোগী
রাশেদা বলেন, ‘গত ১৮ বছরে এই হাসপাতালের জীবন আর শেষ হয়নি। মৃত্যু ছাড়া আর শেষ হবে না। শরীরের যন্ত্রণায় দেড় যুগ ধরে প্রতিটি দিনই আমার কাছে ২১ আগস্ট মনে হয়। প্রতিদিন মৃত্যু দেখি নিজের।’
রাশেদা প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘শরীরভর্তি শত শত স্প্লিন্টারের যন্ত্রণার কথা কী বলব। ব্যথা শুরু হলে মাথা ঠিক থাকে না। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে জিনিসপত্র ভাঙচুর করি। গাড়ির হর্নের শব্দে কান থেকে রক্ত বের হয়। হামলায় আমার ডান কানের পর্দা ফেটেছে, ১৮টি দাঁত পড়ে গেছে। দুই পা কয়েক টুকরা হয়েছিল। ঘুমের ওষুধ না দিলে ঘুম আসে না।’
গত ১৮ বছরে ১৭ বার অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে রাশেদা আক্তারকে। কখনো কানের পর্দার জন্য, কখনো পায়ে কয়েক টুকরা রড বসাতে। সেই যন্ত্রণা শেষ হওয়ার আগেই হয়তো শরীরের চামড়ার ওপরের দিকে থাকা স্প্লিন্টার বের করার চেষ্টা চলছে। ভেতরের দিকে থাকা স্প্লিন্টার মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হবে। আরও কয়েকবার অস্ত্রোপচার করা লাগতে পারে। স্প্লিন্টারের কারণে শরীর ফুলে যায়, চুলকায়। গরমে ঘা হয়। সেই যন্ত্রণা সহ্য হয় না। সামান্য আরামের আশায় শীতে গরম পানিতে পা দিয়ে বসে থাকেন।
এত যন্ত্রণার মধ্যেও রাশেদা ২১ আগস্টের গ্রেনেড বিস্ফোরণের বিকট শব্দ কখনো ভুলতে পারেননি। ঘুমের মধ্যেও সেই শব্দে আতঙ্কে জেগে ওঠেন, দেখেন চারপাশ অন্ধকার। হামলার সময় মাত্র ২৭ বছর বয়সের রাশেদার দুই মেয়েও ছিল ছোট। দেড় যুগে অনেক কিছু বদলেছে, শুধু সেই আতঙ্কের অনুভব এতটুকু বদলায়নি।
গ্রেনেড হামলায় জ্ঞান হারানোর বেশ কিছুক্ষণ পর মিনিট পাঁচেকের জন্য জ্ঞান ফিরেছিল রাশেদার। সবই অস্পষ্ট, তবু ঝাপসা মনে আছে, চারপাশে তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল মানুষের দেহ আর রক্ত।
সামান্য দূরে নিষ্পলক বসে আছেন আইভি রহমান। হামলার আগমুহূর্তে তাঁরা দুজন পাশাপাশি দাঁড়ানো ছিলেন। বুঝলেন, গ্রেনেডের আঘাতে তিনি অনেকটা দূরে ছিটকে গেছেন। এরপর আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি।