অদক্ষতা-অবহেলা

বেশি মজুতের গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন হচ্ছে কম

পুরোনো প্রযুক্তিতে তোলা হচ্ছে গ্যাস। পর্যাপ্ত কূপ খনন করা হয়নি। বিদেশি পরামর্শকের সুপারিশও মানা হয়নি।

দেশের সবচেয়ে বেশি মজুত থাকা তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে কমছে গ্যাসের উৎপাদন। আর তুলনামূলক কম মজুতের একটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে বেড়েছে কয়েক গুণ উৎপাদন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারিগরি পরিকল্পনা ও দক্ষ প্রযুক্তির ব্যবহার না হওয়ায় মজুত থাকার পরও গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। এর জন্য মূলত জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতা দায়ী।

জ্বালানি খাতের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকাজে গতি না থাকায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করা যাচ্ছে না। পুরোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকেও টানা কমছে উৎপাদন। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিও কমানো হয়েছে। এতে করে দেশে গ্যাস সরবরাহের সংকট বাড়ছে। গ্যাসের অভাবে কাজে লাগছে না বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাও।

দেশে বর্তমানে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। গ্যাস মজুতের দিক থেকে সবচেয়ে বড় চারটি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস থেকে উৎপাদন করছে সরকারি কোম্পানি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল)।

পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রে ওই সময়কার কারিগরি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। আর বিবিয়ানায় সব আধুনিক প্রযুক্তি। উৎপাদনের হার বাড়াতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকটি ভাবা হচ্ছে। উৎপাদন বাড়াতে বেশি করে উন্নয়ন কূপ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে বেশি হারে উৎপাদন করে গ্যাসের মজুত দ্রুত শেষ হতে পারে, এটিও চিন্তা করা হচ্ছে।
নাজমুল আহসান, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান

সিলেটের কৈলাসটিলা ও হবিগঞ্জের রশিদপুর থেকে গ্যাস উৎপাদন করে আরেক সরকারি কোম্পানি সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেড (এসজিএফএল)। আর হবিগঞ্জের বিবিয়ানা থেকে গ্যাস উৎপাদন করে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। দেশে দৈনিক উৎপাদনের ৭৫ শতাংশই আসে এই চারটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও গ্যাস উৎপাদনকারী ওই চারটি কোম্পানি সূত্র বলছে, দেশে তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মজুত থাকলেও উৎপাদনে পিছিয়ে আছে তারা। সবচেয়ে কম মজুত নিয়ে কয়েক গুণ বেশি উৎপাদন করছে বিবিয়ানা।

গত জুন পর্যন্ত তিতাস গ্যাসক্ষেত্র থেকে ৫ হাজার ১৮৬ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাস তোলা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিএফসিএল। ৫০ বছর ধরে উৎপাদনে থাকা এ ক্ষেত্রটির উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত বাকি আছে আরও ২ হাজার ৬৯৬ বিসিএফ। এখন পর্যন্ত ২৭টি কূপ খনন করা হয়েছে। দিনে এখন উৎপাদন করা হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪১০ মিলিয়ন ঘনফুট।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রে ওই সময়কার কারিগরি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। আর বিবিয়ানায় সব আধুনিক প্রযুক্তি। উৎপাদনের হার বাড়াতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকটি ভাবা হচ্ছে। উৎপাদন বাড়াতে বেশি করে উন্নয়ন কূপ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে বেশি হারে উৎপাদন করে গ্যাসের মজুত দ্রুত শেষ হতে পারে, এটিও চিন্তা করা হচ্ছে।

কৈলাসটিলায় একটি কূপ খননের কাজ আগামী বছরের মার্চে শুরু হবে। আগামী বছরের মাঝামাঝি এই কূপ থেকে গ্যাস পাওয়া যাবে। পর্যায়ক্রমে ২০২৫ সালের মধ্যে তাদের গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় আটটি নতুন কূপ খনন করা হবে।
মিজানুর রহমান, এসজিএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

কূপ খনন ও প্রযুক্তির ঘাটতি

বর্তমান মজুতের হিসাবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্র কৈলাসটিলা থেকে গত মার্চ পর্যন্ত উৎপাদন করা হয়েছে ৭৮৮ বিসিএফ। আর মজুত আছে ১ হাজার ৯৭০ বিসিএফ। দিনে উৎপাদন করা হচ্ছে মাত্র ৬৮ মিলিয়ন ঘনফুট। আর রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে গত মার্চ পর্যন্ত উৎপাদন করা হয়েছে ৬৮৩ বিসিএফ গ্যাস। মজুত আছে ১ হাজার ৭৫০ বিসিএফ। দিনে উৎপাদন করা হচ্ছে ৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট।

এসজিএফএল সূত্র বলছে, ওই দুটি গ্যাসক্ষেত্রের আটটি কূপ থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে। আরও পাঁচ থেকে ছয়টি কূপ খনন করতে পারলে এখানে উৎপাদন বাড়ানো যেত।

এসজিএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কৈলাসটিলায় একটি কূপ খননের কাজ আগামী বছরের মার্চে শুরু হবে। আগামী বছরের মাঝামাঝি এই কূপ থেকে গ্যাস পাওয়া যাবে। পর্যায়ক্রমে ২০২৫ সালের মধ্যে তাদের গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় আটটি নতুন কূপ খনন করা হবে।

গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে শুরু থেকেই দেশীয় কোম্পানির কারিগরি পরিকল্পনা ছিল না। খাপছাড়া কূপ করে উৎপাদন করে গেছে। সময়ের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও করেনি। দেশের গ্যাস উৎপাদনে কারিগরি দুর্বলতাও আছে।
বদরূল ইমাম, ভূতত্ত্ববিদ

উৎপাদন বাড়িয়েছে বিবিয়ানা

গ্যাসের মজুতের দিক থেকে চতুর্থ হলেও উৎপাদনে শীর্ষে আছে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র। দিনে এখানে উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ২৭টি কূপ থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে ১ হাজার ২৩৫ ঘনফুটের বেশি। দেশের মোট গ্যাস উৎপাদনের অর্ধেক আসে এখান থেকে। উৎপাদন বাড়াতে গত বছর গ্যাস উত্তোলনের পাইপ পরিবর্তন করে বেশি ব্যাসার্ধের পাইপ বসিয়েছে তারা। বর্তমানে এ গ্যাসক্ষেত্রে মজুত আছে ৭৬৪ বিসিএফ গ্যাস।

তবে সক্ষমতার অতিরিক্ত উৎপাদন নিয়ে বিবিয়ানার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। গত ২ এপ্রিল মধ্যরাতের পর বিবিয়ানার গ্যাস প্রক্রিয়াকরণের দুটি ইউনিটে বালু উঠে আসে। বালুর উৎস শনাক্ত করতে না পারায় ছয়টি কূপের উৎপাদন বন্ধ করা হয়। পরে এটি ধীরে ধীরে চালু করা হয়েছে। বেশি উৎপাদনের কারণে এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় তাঁরা সতর্কও করেছেন।

মানা হয়নি পরামর্শ

গ্যাস খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কূপ খননের কাজ আরও বেগবান হলে উৎপাদন বাড়ত। বিবিয়ানার প্রযুক্তি ভালো। গ্যাসের প্রবাহও ভালো সেখানে। এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। আবার পুরোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে বেশি উত্তোলন করতে গেলে সমস্যাও হতে পারে। তবে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে যত জোর দেওয়া যায়, ততই ভালো।

পেট্রোবাংলা বলছে, ২০১০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে মোট ৫০টি উন্নয়নকূপ খনন করা হয়, যার মধ্যে ২২টি করেছে বহুজাতিক কোম্পানি। এসজিএফএল করেছে মাত্র ৪টি ও বিজিএফসিএল করেছে ১৩টি।

একসময় দিনে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হলেও বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। ২০১৮ সালের পর থেকে উৎপাদন কমতে থাকে। ঘাটতি পূরণে এলএনজি আমদানির দিকে ঝোঁকে সরকার। এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন করে দিনে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে পেট্রোবাংলা।

গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্লামবার্জারকে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। ৪১টি কূপ পরীক্ষা করে প্রায় ৪০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর রূপরেখাসহ ২০১১ সালে তারা পেট্রোবাংলায় প্রতিবেদন জমা দেয়। যদিও এটি বাস্তবায়ন করা হয়নি।

এমনকি ২০০৯ সালে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গঠিত গ্যাস উন্নয়ন তহবিলও পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না সরকার। জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত এ তহবিলে জমা পড়েছে ১৬ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা।

সম্প্রতি এলএনজি আমদানি করতে এ তহবিল থেকে ২ হাজার কোটি টাকা সাময়িক ঋণ নিয়েছে পেট্রোবাংলা। এর আগে গত বছর এই তহবিল থেকে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে শুরু থেকেই দেশীয় কোম্পানির কারিগরি পরিকল্পনা ছিল না। খাপছাড়া কূপ করে উৎপাদন করে গেছে। সময়ের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও করেনি। দেশের গ্যাস উৎপাদনে কারিগরি দুর্বলতাও আছে। বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করা হলেও তাদের সুপারিশ মানেনি পেট্রোবাংলা। এর জন্য মূলত জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতা দায়ী।