‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?’ পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন প্রশ্ন রেখেছিলেন তাঁর ‘প্রশ্ন’ কবিতায়। এখন চারপাশের প্রকৃতির রুদ্র রূপে বোঝা যায়, প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করেনি। বৃষ্টি, বন্যা, খরা, দাবানল, শুষ্কতা মিলে সারা বিশ্বে প্রকৃতির যে অদ্ভুতুড়ে অবস্থা, তা যেন প্রকৃতির প্রতিশোধ।
ভারত, পাকিস্তানে যখন বন্যা, তখন দাবানলে পুড়ছে ইউরোপ। আবার চীনের এক পাশ যখন খরায় পুড়ছে, অন্য পাশ তখন বন্যায় প্লাবিত। বাংলাদেশেও প্রকৃতির আচরণ বোঝা দায়। এই খরা তো এই বন্যা। বর্ষায় বৃষ্টির দেখা পাওয়া ভার। শরৎকালে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যাওয়ার বদলে ক্ষণে ক্ষণে কালো মেঘে ঢেকেছে আকাশ। বর্ষার বৃষ্টি ঝরেছে শরতে। দুপুরবেলা কটকটে রোদে শরীর যখন ঘামছে, সন্ধ্যাবেলাতে আবার তখন শীত শীত অনুভূতি।
প্রকৃতির এমন অদ্ভুত আচরণে বিপর্যস্ত মানুষ। আর এই মানুষই প্রকৃতিকে এমন করে তুলেছে। সেই কবে রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর’। এরপরও কেটেছে কত যুগ। অরণ্য আর ফেরেনি। বেড়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন। বেড়েছে জলবায়ুর উষ্ণতা। গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন। আর এত সব গ্যাঁড়াকলে প্রকৃতি ভুলেছে তার নিয়ম। প্রকৃতি এখন তাই এমন পাগলাটে।
গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বড় ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক জলবায়ুবিষয়ক ওয়েবসাইট কার্বন ব্রিফ বলছে, কার্বন নিঃসরণে প্রথমে রয়েছে কানাডা। এরপর যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া। তবে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে এশিয়ার দেশগুলোয়। হঠাৎ আসা প্রবল বর্ষণে এ বছর বিপর্যস্ত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। গত মে ও জুনে বাংলাদেশ ও ভারত বন্যার কবলে পড়ে। কিছুদিন আগের বন্যায় পাকিস্তানে দেড় হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষ বাড়িঘর হারিয়েছে। দেশটির এক-তৃতীয়াংশ পানিতে তলিয়ে গেছে।
সেই কবে রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর’। এরপরও কেটেছে কত যুগ। অরণ্য আর ফেরেনি।
পাকিস্তানে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বন্যার জন্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণকে দায়ী করেছেন। জিও নিউজের খবরে জানা যায়, এক সংবাদ সম্মেলনে গুতেরেস বলেন, ‘আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। এখন প্রকৃতিও পাল্টা প্রতিশোধ নিচ্ছে। এসব কারণে ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’
এএফপির প্রতিবেদনে পাকিস্তানে এমন বন্যার কারণ সম্পর্কে বলেছেন ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গ্রানথাম ইনস্টিটিউটের জলবায়ুবিজ্ঞানের শিক্ষক ফ্রেডরিক ওটো। তিনি বলেন, পাকিস্তানের ঐতিহাসিক নথিপত্রে দেখা যায়, মানুষ বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করা শুরু করার পর থেকে এ অঞ্চলে বৃষ্টি বেড়েছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এই সপ্তাহে বলেছে, গত ৫০ বছরে বিশ্বে আবহাওয়া-সম্পর্কিত দুর্যোগ পাঁচ গুণ বেড়েছে। এতে গড়ে প্রতিদিন ১১৫ জন প্রাণ হারাচ্ছে।
আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। এখন প্রকৃতিও পাল্টা প্রতিশোধ নিচ্ছে। এসব কারণে ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস
সিএনএন ও রয়টার্সের প্রতিবেদনে পাকিস্তানের প্রধান আবহাওয়াবিদ সরদার সরফরাজ সতর্ক করে বলেছেন, উষ্ণতা বাড়ার কারণে হিমবাহ গলতে থাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এর জন্য মূলত জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী। শুধু চলতি বছরই বিভিন্ন হ্রদে হিমবাহ গলার পরিমাণ অন্য সময়ের তুলনায় তিন গুণ বেশি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলো যখন বন্যাপ্লাবিত, তখন মধ্যপ্রাচ্য আরও বেশি উষ্ণ হচ্ছে। আগামী নভেম্বরে মিসরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতিসংঘের কপ ২৭ জলবায়ু সম্মেলন। এই সম্মেলনকে সামনে রেখে রিভিউস অব জিওফিজিক্স সাময়িকীতে প্রকাশিত হালনাগাদ গবেষণা প্রতিবেদনে গবেষকেরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রতি দশকে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ৪৫ ডিগ্রি। আর এ সময়ের মধ্যে প্রতি দশকে বিশ্বে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ২৭ ডিগ্রি।
১৯৮১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা হয়েছে। মিসর, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, বাহরাইন, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরানকে গবেষণার আওতায় রাখা হয়েছিল।
গবেষণায় দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য যে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা-ই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও অঞ্চলটির বড় ধরনের দায়ও আছে। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অন্যতম একটি উৎসে পরিণত হওয়ার পথে আছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের দিক থেকে কয়েক বছরে অঞ্চলটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্থান দখল করে নেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে শুষ্কতা বাড়ার পাশাপাশি ইউরোপে বাড়ছে গরম। চোখ রাঙাচ্ছে দাবানল। এ বছর গ্রীষ্মের দাবদাহে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপ পুড়েছে দাবানলে। ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন ও গ্রিসের হাজার হাজার হেক্টর এলাকা ধ্বংস হয়েছে দাবানলে। দাবানলে মারা গেছে কয়েক শ মানুষ। গরমের কারণে যুক্তরাজ্যে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।
চীনের আবহাওয়া পরিস্থিতি তো অদ্ভুতুড়ে। এ বছরের জুন থেকে আগস্ট মাসে চীন একদিকে বন্যায় ডুবেছে, আবার অন্যদিকে খরায় পুড়েছে। এ সময় চীনের দক্ষিণাঞ্চলের গুয়াংজুতে প্রবল বন্যা হয়। সেই পরিস্থিতির মধ্যেই দেশটির মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়েছে। এর কিছুদিন পর তীব্র দাবদাহের কারণে চীনে ‘হলুদ সতর্কতা’ বা ইয়েলো অ্যালার্ট জারি করা হয়।
ওই সময় জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল গ্রহণ সম্পর্কে চীনা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন চীনের প্রাকৃতিক পরিবেশের ব্যবস্থায় মারাত্মক বিরূপ প্রভাব নিয়ে এসেছে। বন উজাড়, জলাভূমি ভরাট, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচের জন্য পানি জমানোর তো কর্মকাণ্ডের কারণে বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে।
বিবিসিতে আবহাওয়ার এই চরমভাবাপন্ন হয়ে ওঠার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে সম্পর্কিত, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, শিল্পযুগের শুরু থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে নিঃসরিত গ্যাসের কারণে বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে।
যদি বিশ্বব্যাপী এ ধরনের গ্যাসের নিঃসরণ না কমানো যায় তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে প্রকৃতিতে বদল আনছে তার চারটি দিক উল্লেখ করা হয়েছে বিবিসির ওই প্রতিবেদনে।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে দাবদাহ দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে। এ বছর ভারত ও পাকিস্তানে পাঁচটি দাবদাহ বয়ে গেছে। জানুয়ারি মাসে আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে ও ব্রাজিল ঐতিহাসিক দাবদাহের কবলে পড়েছে। একই মাসে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলেও চরম দাবদাহ হয়। গত বছর উত্তর আমেরিকাতেও চরম দাবদাহ হয়। ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়া এ ধরনের দাবদাহ হওয়া সম্ভব নয়।
এ ধরনের পদ্ধতিগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। অবকাঠামোগত অভিযোজন, পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থা এবং দ্রুত আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য কার্যকর মাধ্যম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সব কটি ভাগই কাজে লাগিয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি দাবদাহের কারণে ভয়াবহ খরা হচ্ছে। দাবদাহের সময় বৃষ্টি কম হয়। মাটির আর্দ্রতা ও পানি সরবরাহ দ্রুত ফুরিয়ে আসে। ফলে ভূপৃষ্ঠ দ্রুত উষ্ণ হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এনভায়রনমেন্টাল প্রোগ্রাম কোপারনিকাস বলছে, এ বছর ইউরোপে যে খরা হয়েছে, তা ৫০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে দাবানল বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দাবদাহ তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। দাবদাহের কারণে ভূমি ও গাছপালা থেকে অনেক বেশি আর্দ্রতা হারিয়ে যাচ্ছে। গাছপালা ও মাটির এই শুষ্কতার কারণে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিস, ক্রোয়েশিয়া ও আলবেনিয়ায় সম্প্রতি বেশ কয়েকটি দাবানল হয়েছে। কয়েক হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কয়েক শ লোক মারা গেছে।
কানাডায় গত গ্রীষ্মে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে দাবানল হয়। এই দাবানল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে আকাশে বজ্রমেঘ তৈরি হয়। এই মেঘ থেকে বজ্রপাতের কারণে দাবানল আরও ছড়িয়ে পড়ে।
বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকদের স্বাধীন সংস্থা ক্লাইমেট সেন্ট্রাল বলছে, ১৯৭০ সালের তুলনায় পশ্চিম আফ্রিকায় এখন সাত গুণ বেশি দাবানল বেড়েছে। দাবানল ১০ হাজার একরের বেশি এলাকায় ছড়িয়েছে।
এভাবে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে আমাদের দেশে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় পৌনে ২ কোটি মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গৃহহীন হয়ে পড়তে পারে। শিল্পোন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে ১০ হাজার কোটি ডলার বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করা হয়নি।পরিবেশ ও জলবায়ু অর্থায়ন বিশ্লেষক এম জাকির হোসেন খান
আবহাওয়া চক্র অনুসারে, গরম আবহাওয়া একপর্যায়ে বাতাসের আর্দ্রতা ও জলীয় বাষ্প বাড়িয়ে তোলে। এরপর বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। জলীয় বাষ্পের চাপের কারণে অনেক সময় ছোট একটি এলাকায় অল্প সময়ের জন্য বেশি বৃষ্টি হয়। এ বছর স্পেন ও অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাঞ্চলে বেশির ভাগ এলাকায় বন্যা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে মাত্র ৬ দিনে বছরের গড় বৃষ্টির ৮০ শতাংশ হয়েছে। সিডনিতে তিন মাসের মধ্যে গড় বৃষ্টির চেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের পানি বিশেষজ্ঞ পিটার গ্লেইক বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ ধরনের বৃষ্টি হচ্ছে। সাইবেরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলের মতো এলাকায় যখন খরা বেড়েছে, তখন এর প্রভাবে অন্য কোনো ছোট এলাকায় পানিপ্রবাহ বেড়েছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন বলছে, বন্যাপ্রবণ দেশগুলো কয়েক দশক ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণের পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। যাতে অন্য দেশগুলো সহজেই এগুলো অনুসরণ করতে পারে।
এ ধরনের পদ্ধতিগুলো তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। অবকাঠামোগত অভিযোজন, পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থা এবং দ্রুত আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য কার্যকর মাধ্যম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সব কটি ভাগই কাজে লাগিয়েছে।
নিম্নাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকাগুলোকে ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরেই বন্যা প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে বিনিয়োগ করছে। বন্যার ঝুঁকিতে থাকা উপকূলের নিকটবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের বন্যা প্রতিরোধী ঘরবাড়ি নির্মাণে উৎসাহিত করা হয়েছে।
এ কাজের জন্য তাদের অর্থও বরাদ্দ করা হয়েছে। উঁচু ভূমিতে আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে নারীদের থাকার সুবিধা ও পশুপাখিদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যার্ত ব্যক্তিদের নিয়ে যেতে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করেন। আমলাতান্ত্রিকতা ছাড়াই অর্থ, মুঠোফোনে টাকা পাঠানোসহ আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এসবই বন্যার্ত মানুষের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করছে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ ছিল তখন ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়। ২০২০ সালে প্রায় এ রকমই আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ে মাত্র ৩০ জন মারা যায়।
বন্যা প্রতিরোধে অনেক দেশের বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। আফ্রিকার দেশগুলো এখন এই চেষ্টা চালাচ্ছে।
এটা স্পষ্ট যে বন্যা প্রতিরোধে পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি। এর একটি কারণ হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, সে ব্যাপারে পর্যাপ্ত মনোযোগ না দেওয়া। কেবল পাকিস্তান নয়, ধনী দেশগুলোও এ ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগী নয়।
তবে ইকোনমিস্টের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানে বন্যায় এত ক্ষয়ক্ষতির বড় কারণ রাজনীতি। গত এপ্রিলে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন।
এ ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সরকারি ত্রাণব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পাকিস্তান আর্থিক সহায়তাও পায়নি। পাকিস্তানকে এ ধরনের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে বিশ্ব যে প্রস্তুতি নিয়েছে, তা যথেষ্ট নয়।
২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা ছিল কমপক্ষে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমানো। তবে সেটার বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হয়নি বলছেন বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু অর্থায়ন বিশ্লেষক এবং চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান।
তাঁর আশঙ্কা এভাবে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে আমাদের দেশে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় পৌনে ২ কোটি মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গৃহহীন হয়ে পড়তে পারে। শিল্পোন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোয় ১০ হাজার কোটি ডলার বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করা হয়নি বলেন এই জলবায়ু বিশ্লেষক।
শেষ করা যাক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাস দিয়ে। লবটুলিয়া ও আজমাবাদের বনের জমি প্রজাবিলি করার কাজে গিয়ে সেই বনের মায়ায় পড়ে যান লেখক। তবে শেষ পর্যন্ত সে কাজ তাঁকে করতে হয়। ঘন বন কেটে শস্যপূর্ণ জনপদ বসাতে হয়। লেখক তাই ‘আরণ্যক’–এর সমাপ্তি টেনেছেন এভাবে, ‘হে অরণ্যাণীর আদিম দেবতারা, ক্ষমা করিও আমায়।’
দৈনন্দিন প্রয়োজনে, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে যুগের পর যুগ ধরে প্রকৃতিকে আমরাও ধ্বংস করছি। আর তাই এবার প্রকৃতির শোধ নেওয়ার পালা।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, এএফপি, গার্ডিয়ান, ডন