বাবা মন্ত্রী, অধীন প্রতিষ্ঠানে ছেলের ঠিকাদারি

সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের ছেলের প্রতিষ্ঠান ঠিকাদারি কাজ করেছে মন্ত্রণালয়টির অধীন প্রতিষ্ঠান এনআইবিতে।

  • ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইয়াফেস ওসমানের ছেলের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সাইটেক কনসালটিং সলিউশন।

  • অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মন্ত্রীর ছেলেকে কাজ পাইয়ে দিতে সহায়তা করেন এনআইবির মহাপরিচালক মো. সলিমুল্লাহ।

আওয়ামী লীগ সরকারে ইয়াফেস ওসমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীন দুটি সংস্থায় ঠিকাদারি কাজ করেছেন তাঁর ছেলে ইশরার ওসমান। ইশরারের প্রতিষ্ঠান সাইটেক কনসালটিং সলিউশন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেখানে কাজ পায়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মন্ত্রীর অধীন প্রতিষ্ঠানে তাঁরই ছেলের ঠিকাদারি কাজ করা স্বার্থের সংঘাত বা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট।

সাইটেক কনসালটিং সলিউশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন ইশরার ওসমানের বাবা ইয়াফেস ওসমান মন্ত্রী। ওয়েবসাইটে পরামর্শক হিসেবে দুটি কাজের কথা বলা হয়েছে। দুটিই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থায়। একটি সংস্থা হলো বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এবং অন্যটি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির (এনআইবি)।

প্রাণীর জিন বিন্যাস বা জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য এনআইবিতে ২০২১ সালে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের নকশা ও তদারকির কাজ দেওয়া হয় ইশরার ওসমানের প্রতিষ্ঠানকে। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন মন্ত্রীর ছেলেকে কাজটি পাইয়ে দিতে সহায়তা করেন এনআইবির মহাপরিচালক মো. সলিমুল্লাহ। তাঁর বিরুদ্ধে আরও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ইয়াফেস ওসমানই তাঁকে মহাপরিচালক নিয়োগ করেছিলেন। সে ক্ষেত্রেও নিয়ম মানা হয়নি।

ইশরার ওসমানের প্রতিষ্ঠানটি নতুন। এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। চেয়ারম্যান সমীর উজ্জামান। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিসিএসআইআর ও এনআইবিতে দুটি প্রকল্পে তারা ৫ কোটি করে মোট ১০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে। মন্ত্রীর সময়ে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা ও সংশ্লিষ্ট কাজের হিড়িক পড়েছিল। আরও কিছু কাজ প্রক্রিয়াধীন ছিল।

সাইটেক কনসালটিং সলিউশনের কার্যালয় ঢাকার বনানীতে। যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা সুব্রত শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের এখন চলমান কোনো প্রকল্প নেই। ইশরার ওসমান এখন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন।

প্রাণীর জিন বিন্যাস বা জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য এনআইবিতে ২০২১ সালে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের নকশা ও তদারকির কাজ দেওয়া হয় ইশরার ওসমানের প্রতিষ্ঠানকে। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন মন্ত্রীর ছেলেকে কাজটি পাইয়ে দিতে সহায়তা করেন এনআইবির মহাপরিচালক মো. সলিমুল্লাহ।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইয়াফেস ওসমানও আত্মগোপনে রয়েছেন। তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করে সাড়া পাওয়া যায়নি। তিনি ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী হন, পরে হন মন্ত্রী। আওয়ামী লীগ সরকারের চার মেয়াদেই তিনি এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন।  

এদিকে এনআইবি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৩ সালে মো. সলিমুল্লাহকে জাপান থেকে ডেকে এনে এনআইবিতে সরাসরি প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেন ইয়াফেস ওসমান। মাত্র এক বছর সাত মাসের মাথায় তিনি প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নিয়োগ পান। এখনো তিনি ‘অতিরিক্ত দায়িত্ব’ পালন করছেন। সেখানে এত বছরেও স্থায়ীভাবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো কর্মকর্তা কোনো প্রতিষ্ঠানে চলতি দায়িত্ব বা অতিরিক্ত দায়িত্ব ছয় মাসের বেশি পালন করলে অর্থ বিভাগের সম্মতি নিতে হয়। কিন্তু মো. সলিমুল্লাহ অর্থ বিভাগের সম্মতি নেননি।

২০১০ সালে সাভারে সাড়ে ১১ একর জায়গার ওপর এনআইবি প্রতিষ্ঠিত হয়। জীবপ্রযুক্তি বিষয়ে এটি একটি স্বতন্ত্র গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, টানা প্রায় ১০ বছর একটি প্রতিষ্ঠানে ‘অতিরিক্ত দায়িত্ব’ হিসেবে মহাপরিচালক থাকার ঘটনা নজিরবিহীন। মো. সলিমুল্লাহ যেমন অনিয়ম করেছেন, তেমনি প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদেরও অনিয়মের সুযোগ দিয়েছেন। অবশ্য মো. সলিমুল্লাহ অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ইয়াফেস ওসমানের ছেলে হিসেবে ইশরারকে কোনো সুবিধা দেওয়া হয়নি। যোগ্যতাবলে তিনি কাজটি পেয়েছেন।

এনআইবির কর্মকর্তারা বলছেন, দরপত্রে এমনভাবে শর্ত নির্ধারণ ও বাছাই করা হয়েছে, যাতে ইশরার ওসমানের প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। তাঁরা মো. সলিমুল্লাহর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন ২২টি। ২০১৫ সালে এনআইবির মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মো. সলিমুল্লাহ স্ত্রী চমন আরার সঙ্গে যৌথভাবে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন ৯০টি প্রবন্ধ, যা অস্বাভাবিক। সব কটিই প্রকাশ করা হয়েছে এনআইবি থেকে।

এদিকে এনআইবি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৩ সালে মো. সলিমুল্লাহকে জাপান থেকে ডেকে এনে এনআইবিতে সরাসরি প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেন ইয়াফেস ওসমান। মাত্র এক বছর সাত মাসের মাথায় তিনি প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নিয়োগ পান। এখনো তিনি ‘অতিরিক্ত দায়িত্ব’ পালন করছেন।

আরও অনিয়ম

এনআইবির মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কেশব চন্দ্র দাস ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুসলিমা খাতুন ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপের আওতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। আগামী ডিসেম্বরে তাঁদের পিএইচডি শেষ হওয়ার কথা। ফেলোশিপের নীতিমালায় বলা আছে, আবেদনকারী হবেন সার্বক্ষণিক গবেষক এবং এ সময় তিনি ছুটিতে থাকবেন। অথচ ছুটিতে থাকা অবস্থায় তাঁরা দুজন প্রতিষ্ঠানটির ৪৭ কোটি টাকা ও ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ের দুটি প্রকল্পে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

কেশব চন্দ্র দাস গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ২০২০ সালের মার্চে তিনি শিক্ষা ছুটি নেন। এরপর দেশজুড়ে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। তখন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে ইয়াফেস ওসমানের পরামর্শে তিনি প্রকল্পের দায়িত্ব নেন। প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি শিক্ষা ছুটি নেননি বলে দাবি করেন।

যদিও কেশব চন্দ্র দাস পিএইচডি ও প্রকল্পের কাজ একই সঙ্গে করেছেন। ফেলোশিপের অংশ হিসেবে তিনি মাসে ৪০ হাজার টাকা করে পান। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে তিনি গাড়িসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন।

এনআইবিতে নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন আছে। মহাপরিচালকের দায়িত্ব পেয়ে মো. সলিমুল্লাহ ২০১৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানে বায়োইনফরমেটিকস নামের একটি বিভাগে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। তখনো প্রতিষ্ঠানটির জনবলকাঠামোতে বায়োইনফরমেটিকস নামে কোনো বিভাগ ছিল না।

ওই পাঁচজন যোগ্যতাবলেই চাকরি পেয়েছেন। তাঁদের চাকরি পাওয়ার সঙ্গে তাঁর (চমন আরা) কোনো সম্পর্ক নেই।
এনআইবির মহাপরিচালক মো. সলিমুল্লাহর স্ত্রী চমন আরা

নথিপত্র অনুযায়ী, তখন অনুমোদনহীন বায়োইনফরমেটিকস বিভাগে পাঁচজনকে বিজ্ঞানী নিয়োগ দেওয়া হয়, যাঁরা সবাই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই বিভাগে শিক্ষকতা করেন এনআইবির মহাপরিচালক মো. সলিমুল্লাহর স্ত্রী চমন আরা। চমন আরা প্রথম আলোকে বলেন, ওই পাঁচজন যোগ্যতাবলেই চাকরি পেয়েছেন। তাঁদের চাকরি পাওয়ার সঙ্গে তাঁর (চমন আরা) কোনো সম্পর্ক নেই।

এনআইবিতে কর্মচারী নিয়োগ, নিজের গাড়ি প্রকল্পে ভাড়া দেওয়া, জ্যেষ্ঠতার তালিকা তৈরিতে অনিয়মসহ আরও অভিযোগ রয়েছে। এসব অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ইয়াফেস ওসমানের বিরুদ্ধে। স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে এখন মো. সলিমুল্লাহর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শাহেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের প্রেক্ষাপটে ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি যতটা কাজ করার কথা ছিল, তা করেনি। প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গড়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, বর্তমান মহাপরিচালকের অনিয়মের বিষয়ে কমবেশি অনেকে জানে। দীর্ঘদিন একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকলে এমনটি হয়।