এলজিইডির সড়ক

গ্রামীণ সড়কের ২৫ শতাংশ ব্যবহারের অনুপযোগী

সংস্কারের দু-এক বছরের মধ্যেই অনেক সড়ক ভেঙে যায়। কিছু সড়ক বছরের পর বছর সংস্কার হয় না।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার সান্দিয়ারা থেকে লাহিনীপাড়া পর্যন্ত সড়কটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটারের সংস্কার হয়নি গত ১৭ বছর। ফলে সড়কটিতে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ। কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছে বড় গর্ত। দেখে বোঝার উপায় নেই যে সড়কটি কাঁচা না পাকা।

এটির মতো স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে থাকা গ্রামীণ সড়কের একটি বড় অংশ বেহাল। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২৫ শতাংশের বেশি সড়ক একেবারে ব্যবহারের অনুপযোগী। যদিও বিগত তিন অর্থবছরে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে রাজস্ব খাত থেকে এলজিইডি ব্যয় করেছে প্রায় ৬ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা।

এলজিইডির প্রকৌশলী, সড়ক বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক অগুরুত্বপূর্ণ সড়কে রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করা হয়। কিন্তু জরুরি হলেও অনেক সড়ক সংস্কারে বরাদ্দ দেওয়া হয় না। আবার সড়কে কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সাধারণত সড়ক নির্মাণের পাঁচ বছরের মধ্যে সংস্কার করা হয় না। কিন্তু দেখা যায় নির্মাণের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সড়ক ভাঙতে শুরু করে। দু-তিন বছরের মধ্যেই সড়ক বেহাল হয়ে যায়।

গ্রামীণ কাঁচা সড়কের পাশাপাশি অনেক পাকা সড়কও বেহাল। অনেক ক্ষেত্রে নতুন সড়ক তিন বছরও টিকছে না। এত টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কগুলো রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত না হলে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
শাহাদাত হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, আইইবি

গ্রাম ও উপজেলা পর্যায়ের এই সড়কগুলো স্থানীয় মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, ভালো যোগাযোগব্যবস্থা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জরুরি।

সরকারের জাতীয় সড়কব্যবস্থার শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, দেশের সব উপজেলা সড়ক এবং ইউনিয়ন সড়কের একক দায়িত্ব এলজিইডির। গ্রামীণ সড়কের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও এলজিইডির। বর্তমানে দেশের স
বচেয়ে বিস্তৃত সড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে সংস্থাটির আওতায়, মোট ৩ লাখ ৩০ হাজার ৮৩১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ পাকা, ৫৫ শতাংশ কাঁচা।

রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ কত

সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে রাজস্ব খাত থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা আগের অর্থবছর থেকে ৫৭০ কোটি টাকা বেশি।

এলজিইডির একাধিক প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, এলজিইডির ৫০ শতাংশ সড়ক সব সময় ভালো থাকে, ২৫ শতাংশের মোটামুটি মেরামত প্রয়োজন। আর ২৫ শতাংশ ব্যবহারের অনুপযোগী থাকে। ব্যবহারের অনুপযোগী এসব সড়কের প্রায় সবটাই গ্রামের। প্রতিবছর অনেক সড়ক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। বিপরীতে কাঁচা রাস্তাগুলোতে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বছরের পর বছর এই সড়কগুলো ভাঙাচোরা থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বরাদ্দ দেওয়া হলেও অন্য গাফিলতিতে কাজ হয় না।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার সান্দিয়ারা থেকে লাহিনীপাড়া সড়কটি সংস্কারে ১৫ কোটি টাকার দরপত্র হয়েছিল। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর কাজ শুরু হয়। কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০২০ সালের ৩১ মে। কিন্তু ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ে সন্তোষজনকভাবে কাজ করতে পারেনি। একাধিকবার লিখিত তাগাদা দেওয়ার পরও অগ্রগতি না হওয়ায় চুক্তি বাতিল করে এলজিইডি।

কুষ্টিয়া এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুর রহমান মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, কুষ্টিয়া জেলায় এলজিইডির আওতায় যত সড়ক রয়েছে, তার মধ্যে ৭০ শতাংশ সড়ক চলাচলের উপযোগী। বাকি ৩০ শতাংশ সড়ক ভাঙাচোরা। চলাচলের একেবারে অনুপযোগী সড়ক সংস্কারের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

এলজিইডির আরও যেসব সড়ক চলাচলের অনুপযোগী, তার মধ্যে রয়েছে নোয়াখালী সদর উপজেলার মাইজদী-ওটারহাট সড়কটি। এ সড়কের আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা আলী আকবর প্রথম আলোকে বলেন, হাজার হাজার মানুষ সড়কটি দিয়ে যাতায়াত করে। সড়কের ভাঙা অংশে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। গত মঙ্গলবারও এই সড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা গর্তে পড়ে উল্টে গিয়ে পাঁচজন যাত্রী আহত হন।

নোয়াখালীতে এলজিইডির আওতাধীন প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সড়কের অবস্থাই খারাপ। ৩ হাজার ৫১৯ কিলোমিটার পাকা সড়কের মধ্যে ২ হাজার ১৯২ কিলোমিটারের সংস্কার প্রয়োজন। এর মধ্যে ৭০৮ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা একেবারে বেহাল। এলজিইডির নোয়াখালী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইকরামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সড়ক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

সড়ক টেকে না

এলজিইডির সড়ক নির্মাণের পর তা বেশি দিন না টেকার অভিযোগ রয়েছে। সড়ক সংস্কারের পর এক থেকে দুই বছরে ভেঙে গেলে মানুষ সুফল পায় না।

মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের আবদুল আজিজ সড়কের দৈর্ঘ্য চার কিলোমিটার। সড়কটি ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সংস্কার করা হয়। দুই বছর না যেতেই সড়কটির অবস্থা বেহাল। ঘুরে দেখা যায়, সড়কের বিভিন্ন অংশ দেবে গেছে। অন্তত ২০ স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের।

মাদারীপুরে এলজিইডির বেশ কয়েকটি গ্রামীণ সড়কই চলাচলের অনুপযোগী। সংস্থাটির মাদারীপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফ আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চলতি অর্থবছরে ৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই বরাদ্দের একটি অংশ গ্রামীণ সড়কের সংস্কারে ব্যয় হবে।

এলজিইডি সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে চার ধরনের কাজ করে, যেসব সড়কে গর্ত তৈরি হয়েছে, সেগুলো ভরাট করা (রি-সিল), মোটামুটি থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত (ওভার-লে), সড়কের আয়ুষ্কাল কমে গেলে তা পুনর্বাসন করা এবং সড়ক প্রশস্ত করা। তবে রক্ষণাবেক্ষণ কাজের বড় অর্থই ব্যয় হয় মেরামতের কাজে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রক্ষণাবেক্ষণের অর্ধেক টাকাই ওভার-লে বা মেরামতে ব্যয় হয়েছে।

এলজিইডির প্রকৌশলীরা বলছেন, গ্রামীণ সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অন্যতম কারণ অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যানবাহন চলাচল। উপজেলা সড়ক ও ইউনিয়ন সড়কে ৮ দশমিক ২ টন এবং গ্রামীণ সড়কে ৫ টনের বেশি পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে এর চেয়ে অধিক ওজনের যানবাহন চলাচল করছে। ফলে সড়ক দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া অতিবৃষ্টি, সড়কের পাশের পুকুরের পাড় বাঁধানো না থাকা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সড়কের ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সড়ক দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ঠিকাদারদের মাধ্যমে নিম্নমানের নির্মাণকাজ ও দুর্নীতিকেও দায়ী করেন।

বরাদ্দ ‘কম’

এলজিইডির কর্মকর্তাদের দাবি, ১৯৯২-৯৩ অর্থবছর থেকে সরকার রাজস্ব খাতের মাধ্যমে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ দিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এই খাতে অর্থের চাহিদাও বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম পাওয়া যায়। এতে প্রতিবছর প্রয়োজনীয় সংখ্যক সড়ক সংস্কার করা সম্ভব হয় না।

এলজিইডির রক্ষণাবেক্ষণ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী এ এস এম মহসীন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর যে পরিমাণ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, চাহিদা থাকে তার দ্বিগুণ। প্রতিবছর বরাদ্দের প্রায় ৭৫ শতাংশই উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কে দেওয়া হয়। গ্রামীণ সড়ক বেশি হলেও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব কম পায়। দুই কিলোমিটারের নিচের সড়কগুলো উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সংস্কারের এখতিয়ার আছে, তারা এটি নিয়মিত করলে সড়কের পরিস্থিতি ভালো থাকবে।

অবহেলিত গ্রামীণ সড়ক

উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়ক বাদে এলজিইডির গ্রামীণ সড়ক রয়েছে ২ লাখ ৫৭ হাজার কিলোমিটারের বেশি। এর মধ্যে কাঁচা সড়ক ১ লাখ ৭২ হাজার কিলোমিটারের বেশি। অর্থাৎ মোট গ্রামীণ সড়কের ৬৭ শতাংশই কাঁচা। সচরাচর কাঁচা রাস্তাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে এলজিইডি অর্থ বরাদ্দ দেয় না।

যেমন দিনাজপুরের খানসামা উপজেলায় পূর্ব বাসুলী বাজার থেকে মনাগঞ্জ পর্যন্ত সড়কটি তিন কিলোমিটার। সাড়ে তিন বছর ধরে সড়কটিতে ইটের খোয়া বিছানো। পিচঢালাই হয়নি। সড়কটি যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। চলাচলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

নতুন সড়ক নির্মাণের বরাদ্দ কমিয়ে বিদ্যমান সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে জোর দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামীণ কাঁচা সড়কের পাশাপাশি অনেক পাকা সড়কের অবস্থাও বেহাল। অনেক ক্ষেত্রে নতুন সড়ক তিন বছরও টিকছে না। এত টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কগুলো রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত না হলে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এলজিইডি রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে বড় প্রকল্প নিয়ে নতুন সড়ক করতে বেশি আগ্রহী।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী এবং প্রতিনিধি, দিনাজপুরমাদারীপুর)