বিজয় কি-বোর্ডের বাধ্যতামূলক ব্যবহারের ঘোষণা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। কারণ, এই কি-বোর্ডের আবিষ্কারক খোদ ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে যখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকতাম, তখন সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার সুবাদে একটি সরকারি সংস্থার কাজকর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। তার নাম এসিসি বা ‘অ্যান্টিকম্পিটিশন কমিশন’, যার কাজ ছিল মুক্তবাজার দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিযোগিতানাশক যেকোনো সংস্থার অপকর্ম চিহ্নিত করা ও ওই সংস্থার টুঁটি চেপে ধরা।
বাংলাদেশে এ ধরনের একটা কমিশনের প্রয়োজন অনুভব করবেন সুস্থ ও উন্নতিকামী সবাই। কারণ, নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার এক নতুন বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছে এবং তখন থেকেই এর প্রবৃদ্ধি এক নবগতির মাত্রা পেয়েছে। এ বিষয়ে যেকোনো একটা কাগজে প্রবৃদ্ধিরেখা আঁকলে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই তা ধরতে পারবেন।
প্রতিযোগিতা কমিশন ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করলেও তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের একটা বিষয়ে একধরনের নীরব মতৈক্য রয়েছে—তার নাম বাজার অর্থনীতির বিকাশ। শুধু এক মোবাইল ফোন শিল্পের দিকে তাকালেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কীভাবে এই শিল্প আমাদের বিনিয়োগ ও লাখ লাখ কর্মসংস্থান বাড়িয়েছে, তা এক বিস্ময়কর উন্নতির নিদর্শন। পাল্টে দিয়েছে জীবনধারা। এর অর্ধেক অবদান রাখতে সরকারি নিয়ন্ত্রণে লালিত–পালিত টিঅ্যান্ডটি বোর্ডকে (বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড) হাজার দুয়েক বছর ব্যয় করতে হতো।
এ রকম একটা যুগে বাস করে যখন দেখলাম মুঠোফোনে ‘বিজয় কি-বোর্ড’-এর বাধ্যতামূলক ব্যবহারে সরকারি নির্দেশ জারি হয়েছে, তখন ঠাহর করলাম কোথাও একটা ভেজাল আছে। এটি হাস্যকর ফরমান ও প্রতিযোগিতা-বিরুদ্ধ এক আদেশ। একদিন আমেরিকার ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও বা এনপিআরের খবরে শুনলাম, উত্তর কোরিয়ায় প্রতিটি ঘরে রেডিও বসানো আছে।
সেটা থেকে শুধু সরকারি খবর শুনতে প্রতিটি পরিবারকে বাধ্য করা হয়। বিজয় কি-বোর্ডের বাধ্যতামূলক ব্যবহার নিয়ে এ ঘোষণার মধ্যে কোথায় যেন উত্তর কোরীয় গন্ধ ভেসে আসে। কিন্তু বাংলাদেশ কখনো উত্তর কোরিয়া হবে না। রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। মুক্তবাজারে প্রতিযোগিতায় নেমে মানুষ ভাগ্য গড়েছে ও নিরন্তর গড়ে যাচ্ছে। এখানে প্রতিযোগিতারোধক যেকোনো সিদ্ধান্তই আত্মঘাতী, অর্থনীতির জন্য অমঙ্গলজনক।
এই কি-বোর্ডের আবিষ্কারক খোদ ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী। নিজের সৃষ্টিতে তাঁর দরদ থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু আজ তিনি ক্ষমতায় আছেন বলেই তাঁর একটা অ্যাপ সবার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন—এটা কি বাজার অর্থনীতির নীতিমালায় গ্রহণযোগ্য? এই একচেটিয়া বা মনোপলি রোগ পেয়েছিল বিএনপি আমলের একজন মন্ত্রীর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে।
চাটগাঁবাসী এই মন্ত্রী একমুখে মুক্তবাজারের কথা বলে নিজের মোবাইল কোম্পানিকে মোটামুটি একচ্ছত্র ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী সরকার মুঠোফোনশিল্পকে আরও উন্মুক্ত করে দেয়। তখন প্রতিযোগিতার দৌড়ে ওই ঘরজামাই মোবাইল কোম্পানিটি অকালে পরলোকগমন করে।
বর্তমান টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর আদরের কি–বোর্ড বা অ্যাপও প্রতিযোগিতায় পড়ে সে রকম একটা পরিণতি বরণ করতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই কি মন্ত্রী সাহেব তাঁর অ্যাপকে নিজের পাবলিক অফিস ব্যবহার করে সরকারি সুরক্ষা দিয়ে এই একচেটিয়া বা মনোপলির লাইসেন্স দিলেন?
টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মহোদয় বাংলা সফটওয়্যারের উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। এ কথা প্রধানমন্ত্রীও জানেন। তাঁকে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী বানানোর পেছনে এ অনুভূতি যে কাজ করেছে, সে রকম অনুমান অমূলক নয়। কিন্তু তাই বলে তাঁর সফটওয়্যার যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, সে কথা প্রমাণের কোনো ভিত্তি নেই। শোনা যায়, সমজাতীয় অনেক কি-বোর্ডের তুলনায় এটি কম ডাউনলোড করা হয়। তারপরও অ্যান্ড্রয়েড ফোনে এটিকে বাধ্যতামূলক করা অনেকটা উর্দুর স্টাইলে চাপিয়ে দেওয়া ভাষাপ্রেম নয় কি?
যেটা সবচেয়ে জনপ্রিয় এমনকি সেটাকেও বাধ্যতামূলক করা অযৌক্তিক। কারণ, প্ল্যাটফর্ম বা সফটওয়্যারের প্রিয়তা জোয়ার–ভাটার মতোই বাড়ে–কমে। মাইক্রোসফট ও অ্যাপলের অপারেটিং প্ল্যাটফর্মের প্রিয়তা ও ব্যবহার এভাবেই বেড়েছে বা কমেছে। ফোনে ফোনে বাংলা চাপিয়ে দিলেই সেটা যদি ভাষাপ্রেম হয়ে যেত, তাহলে প্রেসিডেন্ট এরশাদও হতে পারতেন ভাষাদরদি। কারণ, তিনি ডিগ্রি পরীক্ষা থেকে মাতৃভাষার প্রতি দরদ দেখিয়ে ইংরেজি তুলে দিয়েছিলেন।
উত্তর নিউইয়র্ক রাজ্যে সেরাকিউস শহরে রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে। বাংলাদেশের একজন বাঙালি হিসেবে আমি মনস্থ করলাম রবীন্দ্রনাথের ওপর একখানা লেখা দেব। কিন্তু টাইপ করি কীভাবে। কলকাতার প্রকৌশলী প্রবাল সান্যাল জানালেন, বাংলাদেশের ফ্রি সফটওয়্যার ‘অভ্র’ পিসিতে ভরে নিলে টাইপ করা মানে এক আনন্দের বিষয়। ‘আমার সোনার বাংলা’ ইংরেজিতে লিখলে সঙ্গে সঙ্গে বাংলা টাইপ হয়ে যায়।
সে থেকে অভ্র ব্যবহার করে কত সংকলন হয়ে গেল এখানে। আমি বাংলা লিখতে গিয়ে অভ্র ব্যবহার করে পরম স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি—এটা কি আমার অপরাধ? তাহলে ভারতীয় অনেক বাঙালিও তো অপরাধী। ওদের বাংলাদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা যায় কি? আমি বিজয় দেখেছি, কিন্তু ‘বিজয় কি-বোর্ড’ শিখিনি—এই অপরাধে আমাকে কি শাস্তি দেওয়া হবে? মন্ত্রিবাক্য লঙ্ঘন বলে কথা!
মন্ত্রী মহোদয় বললেন, তাঁর কি-বোর্ড খোদ তাঁর মন্ত্রণালয়ে বাধ্যতামূলক করা নাকি স্বার্থ ও নীতি সাংঘর্ষিক বা ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ নয়। আরও দু–একজন পদস্থ নীতিপ্রণেতা তাঁদের নিজস্ব প্রযুক্তি জনভোগে চাপিয়ে দিয়ে একচেটিয়া খেলা বা মনোপলি গেমে লিপ্ত। সে অর্থে তিনিই প্রথম নন। মন্ত্রী বললেন, এ থেকে তিনি টাকা কামাচ্ছেন না। টাকা না কামিয়েও কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট ঘটানো যায়। পাবলিক অফিস ব্যবহার করে সম্মানজনক স্বীকৃতি আদায়ও একধরনের কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। এ বিষয় হাইকোর্টে গেলে বিজ্ঞ বিচারকেরা বিশ্লেষণ করে আরও ভালো মতামত দিতে পারবেন। এমনকি রায় মন্ত্রীর বিপক্ষে না গেলেও এই চাপানোর বিষয়টি তাঁর ব্যক্তি ভাবমূর্তির জন্য কিঞ্চিৎ লজ্জা ও অনুকম্পার বিষয়। এ যেন অনেকটা বইমেলায় বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ কবিবন্ধুর চাপে পড়ে তাঁর চারটা কবিতার বই কেনা।
নেটস্কেপ নামক এক ওয়েব ব্রাউজার একসময় খুব প্রসার লাভ করে। মাইক্রোসফটের অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ ব্যবহার করেও সেটা চালানো যেত। উইন্ডোজ যখন প্রায় একচেটিয়াভাবে বাজার দখল করে ফেলল, তখন মাইক্রোসফটের মাথায় চিন্তা এল যে ওর নিজস্ব ওয়েব ব্রাউজার এক্সপ্লোরার মানুষকে কৌশলে গেলাতে হবে, যাতে নেটস্কেপ বা অন্য ওয়েব ব্রাউজার উইন্ডোজের মধ্যে ঢুকতে না পারে। উইন্ডোজের পরের সংস্করণে সে রকম কৌশল করে দেওয়া হলো। আর যায় কোথায়। অন্য কোম্পানিরা মাইক্রোসফটের অধিকর্তা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ ধনী বিল গেটসকে ‘মনোপলিস্ট’ হিসেবে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলা দিল।
উন্নত বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিধিমালা এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে মনোপলিস্ট হওয়া মানে অপরাধ। আমাদের সমাজের মতো গৌরবের নয়। বিল গেটস আদালতে দাঁড়িয়ে বললেন, তিনি মনোপলিস্ট নন। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে ব্যঙ্গ–রসিকতার অন্ত ছিল না।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ গ্রেগরি ম্যাংকিউ এ রকম ছবিসংবলিত একটা কেস স্টাডি পাঠ্যপুস্তকে জুড়ে দিলেন। সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তিটি এ নিয়ে কোনো মানহানির মামলা করেননি, অথবা ম্যাংকিউকে জেলে ঢোকানোর চেষ্টা করেননি। শেষতক বিল গেটস মামলায় হারেন, মিলিয়ন ডলার জরিমানা দেন এবং তাঁর নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেমেও অন্য ব্রাউজারকে প্রবেশাধিকার দিতে বাধ্য হন।
এরই নাম মুক্তবাজারের প্রতিযোগিতা, যা ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ করে, দ্রব্যের উৎপাদন বাড়ায় এবং দিনান্তে মূল্য কমায়। আমাদের দেশে বাজার প্রতিযোগিতার সঠিক বিধিমালা থাকলে মন্ত্রী মহোদয়ও মামলা খেতে পারতেন। রায় তাঁর পক্ষে যাওয়ার কথা নয়। কারণ, তিনি প্রতিযোগিতার গলা টিপে ধরেছেন এবং আমার কবিবন্ধুর মতো জোর করে নিজের কাব্যপ্রতিভা আমার মতো অসহায় ও আনাড়ি পাঠকের কাঁধে চাপাচ্ছেন।
সমাজে তবু একচেটিয়া ব্যবস্থা বা মনোপলি গজায়। রাষ্ট্র তাকে ভেঙে দিলে গড়ে ওঠে মনোপলিস্টিক কম্পিটিশন, সেটা অনেক ভালো। যেমন বহু কোম্পানির প্রতিযোগিতায় গড়ে ওঠা গাড়ির শিল্প। পাঠ্যপুস্তক অনুযায়ী মনোপলি তিন কারণে গড়ে ওঠে। উত্তম কারণ, সবচেয়ে কম দামে মানসম্পন্ন পণ্য বা সেবা দেওয়ার ক্ষমতা। মধ্যম কারণ, কোনো কোম্পানির প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা থাকা। তৃতীয় বা অধম কারণ, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ আদরে ও অনুমোদনে মনোপলি হিসেবে গড়ে ওঠা। মন্ত্রী মহোদয় এখন বুঝে দেখুন, আপনার কি-বোর্ড জনতাকে ব্যবহারে বাধ্য করা কোন শ্রেণির একচেটিয়া ব্যবস্থা বা মনোপলির মধ্যে পড়ে।
ড. বিরূপাক্ষ পাল, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, কোর্টল্যান্ড