পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬ বছর: ভূমিসহ ৩ বিষয়ে অগ্রগতি নেই

ভূমিসহ পার্বত্য চুক্তির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অগ্রগতি না থাকায় পাহাড়িদের স্বশাসন ও বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সইয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্ত
ছবি: সংগৃহীত

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির শুরুতেই এই অঞ্চলকে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। চুক্তিতে এ অঞ্চলের ‘বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ’ করার কথাও বলা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

পাহাড়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ, পাহাড় বিষয়ে গবেষকেরা বলছেন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের এক অনন্য নজির ছিল এই চুক্তি। চুক্তির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধান হলে স্বশাসন ও বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্য অর্জিত হতো। এক. ভূমির বিষয়টি চুক্তি অনুযায়ী জেলা পরিষদের কাছে ন্যস্ত করা। দুই. পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে অভিন্ন ভোটার তালিকা প্রণয়ন। তিন. জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) থেকে নিচের জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা।

কিন্তু এই তিনটি বিষয়ের একটিও সমাধান হয়নি। সরকার দাবি করছে, পার্বত্য চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে ৬৫টির সুরাহা হয়েছে। সরকার বলছে, চুক্তি সম্পাদনকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহযোগিতার অভাবে চুক্তির সফল বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

জেএসএস চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা সরকারের বিরুদ্ধে নানা সময় অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছেন। তাঁরা দাবি করছেন, আদতে মাত্র ২৫টি ধারা পুরোপুরি ও ১৮টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার (২ ডিসেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে।

স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন ও প্রশাসনিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের অনন্য দলিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। কিন্তু পাহাড়ের এসব আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানকে আজও কার্যকর করা হয়নি। ভূমির অধিকার ও নাগরিক অধিকারও সংকুচিত হচ্ছে।
স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ

পেছন ফিরে দেখা

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা

বাংলাদেশ সরকার ও জেএসএসের মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে পাহাড়ে দুই দশকের সশস্ত্র সংঘাতের অবসান হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৯টিই আঞ্চলিক পরিষদের গঠন ও কার্যাবলিসংক্রান্ত।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা, ভূমিসহ নানা বিষয় বাস্তবায়নে জেলা পরিষদ হবে কেন্দ্রবিন্দু। আর আঞ্চলিক পরিষদ তিন জেলা পরিষদের কাজের সমন্বয় করবে—এটিই ছিল চুক্তির কথা।

স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলছিলেন, ‘স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন ও প্রশাসনিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের অনন্য দলিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। কিন্তু পাহাড়ের এসব আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানকে আজও কার্যকর করা হয়নি। ভূমির অধিকার ও নাগরিক অধিকারও সংকুচিত হচ্ছে।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ের মানুষের ভূমি ও নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করছে। কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলছিলেন, ভূমি সমস্যা, ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যেসব শর্ত চুক্তিতে ছিল, সেগুলো দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে।

স্থায়ী বাসিন্দাদের ভোটার তালিকা ছাড়াই তো নির্বাচনে জেএসএসের নেতারা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও সংসদ নির্বাচনে লড়ছেন। জয়ীও হচ্ছেন। তাহলে সমস্যা কোথায়?
চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং

ভূমি সমস্যার সমাধান: চুক্তি ও বাস্তবতা

১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে অন্তত চার লাখ বাঙালিকে পাহাড়ে নেওয়া হয়। তাঁদের জমি দেওয়া হয়। তখন পাহাড়ে জেএসএসের সশস্ত্র লড়াই চলছিল। এ সময় কয়েক হাজার পরিবার ভারতে চলে যায়।

পার্বত্য চুক্তির পর সরকারের তত্ত্বাবধানে ১২ হাজারের বেশি পরিবার দেশে আসে। নানা সময়ে আরও ১৬ হাজার পরিবার দেশে ফিরে। দেশে এসে তারা দেখে, তাদের জমি দখল হয়ে গেছে।

চুক্তির পর এসব সমস্যার সমাধানে সরকার ১৯৯৯ সালে প্রথম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করে। ২০০১ সালে এ-সংক্রান্ত আইন হয়। আপত্তির পর ২০১৬ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। তখন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা হলেও আজও তা চূড়ান্ত হয়নি।

আইন অনুযায়ী, জমির মালিকানার দ্বন্দ্ব নিয়ে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে আবেদন চাওয়া হয়। কমিশনের সচিব মো. নেজাম উদ্দিন গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, এ পর্যন্ত ২২ হাজারের বেশি আবেদন পড়েছে। তবে কোনো আবেদনের সুরাহা হয়নি।

পাহাড়ে অবৈধ ভূমি দখল, ইজারা দিন দিন বাড়ছেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির হিসাবে শুধু বান্দরবানে স্থানীয় প্রশাসন ৪২ হাজার ৫৫৭ একর জমি ইজারা দিয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭০ একর পাহাড়িদের, বাকিটা বাঙালিদের ইজারা দেওয়া হয়েছে।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অবস্থা দেখতে একটি বাস্তবায়ন কমিটি আছে, যার প্রধান এখন সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। এতে আছেন জেএসএস চেয়ারম্যান সন্তু লারমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা) ও খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। শেষ বৈঠক হয় গত জুনে। বৈঠকে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিধিমালার বিষয়টি ওঠে। বৈঠকে বিধিমালা চূড়ান্ত করার দাবি জানানো হয়।

গত সপ্তাহে ভূমি মন্ত্রণালয়ের জরিপ বিভাগের উপসচিব এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিধিমালার খসড়া নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।’

চুক্তির ফলে সৃষ্টি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে আছে, বন্দোবস্তযোগ্য খাসজমিসহ যেকোনো জমি পরিষদের অনুমোদন ছাড়া ইজারা দেওয়া, বন্দোবস্ত, ক্রয়–বিক্রয় বা অন্যভাবে হস্তান্তর করা যাবে না।

কিন্তু পাহাড়ে অবৈধ ভূমি দখল, ইজারা দিন দিন বাড়ছেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির হিসাবে শুধু বান্দরবানে স্থানীয় প্রশাসন ৪২ হাজার ৫৫৭ একর জমি ইজারা দিয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭০ একর পাহাড়িদের, বাকিটা বাঙালিদের ইজারা দেওয়া হয়েছে।

চুক্তিতে থাকলেও আজ পর্যন্ত ভূমির বিষয়টি জেলা পরিষদে ন্যস্ত করা হয়নি। এটি দিন দিন ভূমির সমস্যা বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান চিং কিউ রোয়াজা।

চুক্তি নিয়ে একে অন্যকে দায়ী করছে দুই পক্ষ। এসবের মধ্যে ভূমি, ভোটার তালিকা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বের মতো মৌলিক বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন হারিয়ে যাচ্ছে।

ভোটার তালিকা হলো না

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৯ নম্বর ধারায় পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা করার কথা উল্লেখ আছে। ২৬ বছরেও তা হয়নি। জেএসএস বলছে, সশস্ত্র লড়াইয়ের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করা বাঙালিরা এই ভোটার তালিকায় থাকতে পারবে না। এর আগে যেসব বাঙালি ছিলেন, তাঁরা তালিকাভুক্ত হতে পারবেন।

অবশ্য ভোটার তালিকা নিয়ে সরকারের এখন আগ্রহ কম। যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, স্থায়ী বাসিন্দাদের ভোটার তালিকা ছাড়াই তো নির্বাচনে জেএসএসের নেতারা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও সংসদ নির্বাচনে লড়ছেন। জয়ীও হচ্ছেন। তাহলে সমস্যা কোথায়?

আসলে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা করলে পুনর্বাসিত বাঙালিদের বাদ দিতে হবে। এই ভোটের হিসাব নিয়েই শাসক দলের চিন্তা। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙালিদের ভোট প্রায় সমান। পাহাড়ের ভোটারদের বড় অংশ জেএসএস বা স্থানীয় পাহাড়ি দলগুলোর সমর্থক।

পার্বত্য চট্টগ্রামের শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, ‘এতগুলো বাঙালি পরিবার এখন কোথায় যাবে।’

থমকে আছে পুলিশ নিয়োগব্যবস্থা

পার্বত্য চুক্তির ২৪ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, অন্য আইনে যা–ই থাকুক, পার্বত্য জেলা পুলিশের উপপরিদর্শক থেকে নিম্নস্তরের সব জনবল পরিষদের তত্ত্বাবধানে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিযুক্ত হবে। জেলা পরিষদ তাদের বদলি ও প্রয়োজনে নির্ধারিত পদ্ধতিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে।

স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের মতে, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগের এই ধারা স্থানীয় সরকার গঠনে অত্যন্ত কার্যকর বিধান। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে এমন বিধান আছে এবং তা সফলভাবে কার্যকর হচ্ছে।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশ নিয়োগ নিয়ে কিছু বলা হচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর বলেন, ‘পুলিশ নিয়োগ নিয়ে কিছু হয়েছে বলে জানি না।’

জেএসএসের চলতি বছরের প্রতিবেদনে বলছে, ২০১৮-১৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির সভায় নির্বাহী আদেশে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে ‘পুলিশ (স্থানীয়)’ ও ‘আইনশৃঙ্খলা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ বিষয় হস্তান্তর ও পার্বত্য জেলা পুলিশ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

পরস্পরকে দোষারোপ

চুক্তি নিয়ে একে অন্যকে দায়ী করছে দুই পক্ষ। এসবের মধ্যে ভূমি, ভোটার তালিকা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বের মতো মৌলিক বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন হারিয়ে যাচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে একাধিক বইয়ের লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মোহসিন বলেন, ‘জেএসএসের আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল বিকেন্দ্রীকরণ। চুক্তির মূল চেতনাও তাই। কিন্তু ক্ষমতা উল্টো কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন দেখছি না।’