সারা দেশে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা অথবা তাঁদের পরিবারকে পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছে সরকার।
হালকা সবুজ রঙের দেয়াল। তাতে লাল আর সবুজে আঁকা দুটি সরলরেখা, যেন বাংলাদেশের পতাকার প্রতিচ্ছবি। বাড়ির সামনে নামফলক, লেখা ‘বীর নিবাস’।
এই বীর নিবাস বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। নির্মাণ করে দিয়েছে সরকার। পাকা বাড়ি পেয়ে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, শেষ বয়সে এসে তাঁরা পাকা বাড়িতে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন, যা কখনো ভাবেননি। পাশাপাশি পাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। পাকা বাড়ি আর ভাতার টাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দিন কাটছে সাচ্ছন্দ্যে।
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার মছলন্দপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন পাকা ঘরে ঘুমাব স্বপ্নেও ভাবি নাই।’
অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও প্রয়াত যুদ্ধবীরদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বীর নিবাস নামের প্রকল্পের আওতায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৩০ হাজার পাকা বাড়ি নির্মাণ করছে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় হচ্ছে বীর নিবাস।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভায় গত ৮ নভেম্বর উল্লেখ করা হয়, এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ৫৫৭টি বীর নিবাস নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। আরও ১০ হাজার ৭২৯টির কাজ চলছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পটি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের প্রকল্প। আমরা অত্যন্ত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছি। বাড়ি বানানো ও বরাদ্দে কোনো অনিয়মের অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্ত করা হচ্ছে। প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
মন্ত্রী জানান, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বলতে যাঁদের ৮ শতাংশের বেশি জমি নেই এবং সংসারে আয় করার মতো সক্ষম সন্তান নেই, তাঁদের বোঝাবে। সচ্ছলেরা কোনোভাবেই বীর নিবাস পাবেন না।
দেশে তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৩৩ হাজার। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা পান। দুই ঈদে ১০ হাজার করে ২০ হাজার টাকা উৎসব ভাতা, ৫ হাজার টাকা বিজয় দিবসের ভাতা এবং ২ হাজার টাকা বাংলা নববর্ষ ভাতা পান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বছরে একজন সব মিলিয়ে ভাতা পান ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।
সব বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেলেও সরকার বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছে অসচ্ছলদের।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২১ সালের মার্চে ৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা ব্যয়ের বীর নিবাস প্রকল্প অনুমোদন পায়। মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবরে। কিন্তু সময়মতো কাজ এগোয়নি। তাই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে; কিন্তু মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পযর্ন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
বীর নিবাস পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পাকা বাড়িগুলো একতলা। দেয়াল ইট ও সিমেন্টের। ছাদ পাকা। প্রতিটি বীর নিবাসের আয়তন ৭৩২ বর্গফুট। একেকটিতে দুটি শয়নকক্ষ, একটি বসার কক্ষ (ড্রইংরুম), একটি খাওয়ার কক্ষ (ডাইনিং), একটি রান্নাঘর, একটি বারান্দা ও দুটি শৌচাগার রয়েছে।
প্রতিটি বাড়িতে থাকছে একটি উঠান, একটি নলকূপ এবং গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনের জন্য আলাদা জায়গা ও ছাউনি। প্রথম ধাপে একেকটি বাড়ি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় ধাপে ধরা হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ ১০ হাজার টাকা।
সরকারের একটি কমিটি অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করে। কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। নিয়ম অনুযায়ী, অসচ্ছল বীরাঙ্গনারা সরাসরি পাকা বাড়ি বরাদ্দ পাবেন। অসচ্ছল যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রাধিকার পাবেন। অগ্রাধিকার তালিকায় আরও রয়েছে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার অসচ্ছল স্ত্রী ও সন্তানেরা।
যেসব জেলায় বীর নিবাসে বীর মুক্তিযোদ্ধারা থাকতে শুরু করেছেন, তার একটি ঠাকুরগাঁও। জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায় দুই পর্যায়ে ৪৫ জন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারকে পাকা বাসস্থান নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ১০টি হস্তান্তর করা হয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের জমিতে পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছে সরকার। তবে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার ভেলাতৈড় গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেনের নিজের জমিও ছিল না। তিনি অন্যের জমিতে থাকতেন। তাঁকে সরকারিভাবে ৬০ শতাংশ জমি দেওয়া হয়। সেখানেই বীর নিবাস নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।
আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকার অভাবে ভালো একটি ঘর বানাতে পারিনি। ভাঙা ঘরে অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি। এখন ভালো ঘরে থাকি।’
আমির হোসেনের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর স্ত্রী আয়শা বেগম। তিনি বলেন, ঝড়বৃষ্টিতে এখন আর কিছুই মনে হয় না।
পীরগঞ্জ উপজেলায় প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কারও কারও অসচ্ছল পরিবারও পেয়েছে বীর নিবাস। তাঁদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিনের স্ত্রী রোকেয়া বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ভাতায় তাঁর পরিবার চলে। ভাঙা ঘর মেরামত নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। পাকা বাড়ি পেয়ে তিনি খুশি।
উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, পীরগঞ্জে প্রথম পর্যায়ে হস্তান্তর করা ১০টি বীর নিবাসের প্রতিটিতে ব্যয় হয়েছে ১৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩৫টির কাজ চলছে। সেগুলোর প্রতিটির ব্যয় ১৪ লাখ ১০ হাজার টাকা।
পীরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আখতারুল ইসলাম বলেন, সরকার অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের পাকা বাড়ি উপহার দিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে।
জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় তিন বছরে ৪১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারকে বীর নিবাস তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। উপজেলার হাজীপাড়া গ্রামের অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম বাড়ি পাওয়াদের একজন।
আমিনুল ইসলামের বয়স ৭০ বছর। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি যশোরের একটি পাটকলে মাসে ২৮ টাকা বেতনে চাকরি পান। কষ্টে সংসার চলত। কয়েক বছর পর সেই চাকরিও চলে যায়। তখন পরিবার নিয়ে ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালিয়েছেন, শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন।
আমিনুল ইসলাম আরও বলেন, তিনি খুবই দরিদ্র ছিলেন। কখনো ভাবেননি জীবনের শেষ বয়সে পাকা ঘর পাবেন। তা-ও আবার মেঝে টাইলস করা।
বীর নিবাসের নির্মাণকাজে মানের ঘাটতির অভিযোগও আছে। যেমন কুড়িগ্রামে শেষ হওয়া কাজের মান নিয়ে বরাদ্দ পাওয়া পরিবারগুলো অভিযোগ তুলেছে।
জেলার চিলমারী উপজেলায় ৩৫টি বাড়ি নির্মাণ করছে সাতটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে পাঁচটি করে বাড়ি নির্মাণের কাজ। এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠানের কাজ শেষ। তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাজ চলছে। উপজেলার থানাহাট ও রমনা ইউনিয়নে পাঁচটি বীর নিবাস গত বুধবার ঘুরে দেখেন এ প্রতিবেদক।
চিলমারীর সবুজপাড়া গ্রামের প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী আজমেরী বেগম পাশের পুরোনো টিনের ছাউনির ঘরে থাকেন। বীর নিবাসে থাকেন তাঁর ছেলে। পাকা বাড়ি ছেড়ে টিনের ছাউনির ঘরে কেন থাকেন, জানতে চাইলে আজমেরী বেগম বলেন, সরকারের করে দেওয়া পাকা বাড়িতে নানা সমস্যা। শৌচাগারে ঠিকমতো পানি আসে না। গোসল করলে ওই পানি দেয়াল চুইয়ে শোয়ার ঘরে ঢোকে।
উপজেলার ডেমনারপাড় গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক ও তাঁর পরিবার বীর নিবাসের ঘর পেয়েছেন। রাজ্জাকের স্ত্রী হাসিনা বেগম প্রথম আলোকে জানান, তাঁর ঘরের বারান্দা দিয়ে বৃষ্টির পানি ভেতরে আসে।
রান্নাঘর ও বাথরুমে থাই গ্লাস লাগানো হয়নি। দরজার একদিকে রং করা হলেও অন্যদিকে রং ও বার্নিশ করা হয়নি। নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যে দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছিল। পরে ঠিকাদারের লোকজন পলেস্তারা করে দিয়ে গেছেন; কিন্তু আর রং করেননি।
হাসিনা বেগম আরও বলেন, নলকূপের জন্য ১২০ ফুট পাইপ বসানোর কথা; কিন্তু ৮৫ ফুট পাইপ বসানো হয়েছে। নলকূপের পানিতে গন্ধ। সেই পানি পান করা যায় না।
এসব অভিযোগ পুরোটা সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মুসা হারুন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে আমাদের যেভাবে কাজের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, আমরা সেভাবে কাজ করছি।’
শৌচাগারে পানি না আসা ও দেয়াল চুইয়ে পানি শোয়ার ঘরে যাওয়ার কারণকে মিস্ত্রিদের কাজের ভুল উল্লেখ করে আমিনুল বলেন, এগুলো ঠিক করে দেওয়া হবে। কাজের ধীরগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে সময় কাজ ধরা হয়েছিল সে সময় ইট, রড ও সিমেন্টের দাম কম ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় একটু সময় নিয়ে ধীরে কাজ করা হচ্ছে। তবে কাজের গুণগত মান ঠিক আছে।’
বীর নিবাস করতে সরকার টাকা দিয়েছে। জমি দিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ফলে যাঁর যাঁর বাড়িতেই তাঁরা পাকা ঘর পেয়েছেন। টুকটাক সমস্যা সমাধান হলেই তাঁরা খুশি।
চিলমারীর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বীর নিবাসের কাজে কোনো ধরনের ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের একজন প্রকৌশলী ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন উপসহকারী প্রকৌশলী পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেবেন। তবেই বিল হবে। কাজ শতভাগ না করলে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শতভাগ টাকা পাবে না।’
রোজিনা ইসলাম, ঢাকা, আবদুল আজিজ, জামালপুর, মজিবর রহমান খান, ঠাকুরগাঁও ও জাহানুর রহমান, কুড়িগ্রাম