কাইয়ুম চৌধুরীর দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ করেন আবুল মনসুর। গতকাল ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে
কাইয়ুম চৌধুরীর দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ করেন আবুল মনসুর। গতকাল ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে

কাইয়ুম চৌধুরীর নান্দনিকতা চিত্রকলায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে

শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর বিচিত্র মাধ্যমের শিল্পকর্মে যে নান্দনিকতার প্রকাশ করেছেন, তা দেশের চিত্রকলায় অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তিনি প্রায় একার চেষ্টায় দেশের মুদ্রণশিল্পে পথ সৃষ্টি করেছেন এবং উচ্চতর শৈল্পিক মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি নেই, কিন্তু তাঁর সামগ্রিক শিল্পসুষমা সময়কে অতিক্রম করে প্রাণবন্ত হয়ে থাকবে।

গতকাল শনিবার ছিল বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর দশম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় আলোচকেরা তাঁর সম্পর্কে এই মূল্যায়ন করেছেন। বেঙ্গল শিল্পালয় সন্ধ্যায় তাদের ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কের কার্যালয়ে এ স্মরণসভা আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে কাইয়ুম চৌধুরীর ওপর বেঙ্গল ফাউন্ডেশন নির্মিত একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

সূচনা ভাষ্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ১০ বছর হলো আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু মনেই হয় না এতটা সময় পেরিয়ে গেছে। বেঙ্গল শিল্পালয় আয়োজিত ২০১৪ সালের উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবে আলোচনা করতে তিনি মঞ্চে ছিলেন। সেখানেই আকস্মিকভাবে তাঁর প্রয়াণ। দেশের শিল্পকলার ভুবনকে তিনি তাঁর গভীর জ্ঞান, উপলব্ধি, সৃজনশীলতা ও নান্দনিকবোধে সমৃদ্ধ করে গেছেন। দীর্ঘ ৬০ বছরের শিল্পকলা চর্চায় তিনি শিল্পকলার সব মাধ্যমে কাজ করেছেন। বাংলার প্রকৃতি ও জনসাধারণের জীবনযাপনকে তাঁর চিত্রকলায় তুলে এনেছেন। একটি নিজস্ব চিত্রভাষা ও শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া দেশের মুদ্রণশিল্প ও গ্রাফিক আর্টে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন, তা অনন্য। তাঁর এসব কাজ কালজয়ী হয়ে থাকবে।’

অনুষ্ঠানে ‘মুদ্রণ কলার কাইয়ুম চৌধুরী’ শীর্ষক আলোচনা করেন তাঁর ছাত্র শিল্পী ও শিল্পসমালোচক অধ্যাপক আবুল মনসুর। তিনি বলেন, ভারতে সত্যজিৎ রায় বর্ণমালা ও অলংকরণ নিয়ে যেমন কাজ করেছেন, বাংলাদেশে তেমন ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে এ দেশে শিল্পী কাজী আবুল কাশেম কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলেন। তবে তিনি চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি। তবে প্রচ্ছদের আধুনিকায়ন, অক্ষর নিয়ে নানা ধরনের নিরীক্ষা ও নিজস্ব একটি ধরন তৈরি করাসহ প্রচ্ছদ, অলংকরণ, পোস্টারসহ বিভিন্ন ধরনের গ্রাফিক আর্টে কাইয়ুম চৌধুরী একটি নিজস্ব শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন।

কাইয়ুম চৌধুরীর করা গ্রন্থের প্রচ্ছদগুলোর বৈশিষ্ট্য অনুসারে আবুল মনসুর তিনটি পর্বে ভাগ করে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনায় বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি তুলে ধরে সেগুলোর বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন। এতে তিনি দেখান, প্রথম দিকের বইয়ের প্রচ্ছদে কাইয়ুম চৌধুরী বিষয়বস্তু ও নরনারীর অবয়বকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করেছেন, তবে অক্ষরের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন কম। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রচ্ছদগুলোতে দেখা যায়, তিনি ক্রমেই লেখা, অক্ষরবিন্যাস ও অক্ষরের আঙ্গিকের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। বহু রকম নিরীক্ষা করেছেন। একটা পর্যায়ে এমন এক প্রকারের অক্ষরশৈলী উদ্ভাবন করেছেন, যা দেখেই পাঠক চিনতে পারে—এটি কাইয়ুম চৌধুরীর লেখা। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, বহু জীবনীভিত্তিক বইতে সেই ব্যক্তিদের তিনি অসাধারণ কিছু প্রতিকৃতি এঁকেছেন। অধিকাংশ প্রকৃতিই জলরঙের। এগুলো এতটাই শিল্পগুণসমৃদ্ধ যে তা উচ্চমানের পরিপূর্ণ শিল্পকর্মের স্তরে উন্নীত হয়েছে।

পরে তরুণ প্রজন্মের শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ছাত্র আনিসুজ্জামান সোহেল স্মৃতিচারণা করেন।