পরনে নেভি ব্লু টি-শার্ট আর কালো হাফপ্যান্ট। পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ। চার ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার শরীরে আর কোথাও ছিল না আঘাতের চিহ্ন। এসব তথ্য রাকিব হাসানের সুরতহাল প্রতিবেদনের। আর তাকে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তির সময় যে টিকিট কাটা হয়েছিল, তাতে লেখা ‘হেড ইনজুরি’ বা ‘মাথায় আঘাত’। পাশে বন্ধনীর ভেতরে লেখা ‘গ্রেনেড ব্লাস্ট’ বা গ্রেনেড বিস্ফোরণ।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ চলাকালে ১৯ জুলাই নিহত হয় ১২ বছরের রাকিব হাসান। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আইটিজেড স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত সে। বাবা আবুল খায়ের ও স্নাতকপড়ুয়া বড় ভাই আবু রায়হানের সঙ্গে মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডে এক রুমের একটি ভাড়া বাসায় থাকত। আবুল খায়ের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন অঞ্চল ৫-এ বিদ্যুতের লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে কথা হয় আবুল খায়েরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছেলে কীভাবে মারা গেছে নিশ্চিত নন। প্রতিদিন বিকেলে বাসার কাছের মাঠে ফুটবল খেলতে যেত রাকিব। সেদিনও সে খেলার জার্সি গায়ে দিয়ে বাইরে গিয়েছিল। হয়তো খেলতেই বের হয়েছিল। ১২ বছর বয়সী ছেলে আন্দোলন করতে যাবে, তা মনে হয় না তাঁর।
মৃত্যুর কয়েক দিন আগে রাকিব বাবার কাছে একটি ফুটবল কিনে দেওয়ার জন্য আবদার করেছিল। আবুল খায়ের ভেবেছিলেন, দেশের পরিস্থিতি ভালো হলেই বল কিনে দেবেন। নতুন বল পেলে ছেলেকে ঘরে রাখা কঠিন হবে। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার (১৯ জুলাই) বারবার ছেলেকে বলেছিলাম, “আব্বু তুই আইজ বাইরে যাইস না।” বিকেল পর্যন্ত ঘরেই ছিল। তারপর কোন ফাঁকে বের হয়ে গেছে, তা বুঝতে পারি নাই। এখন আফসোস, একটা বল ছেলেরে কেন কিনে দিলাম না!’
বিছানার তোশকের নিচে রাকিবের প্যান্ট, শার্ট ও লুঙ্গি লুকিয়ে রেখেছেন আবুল খায়ের। স্কুলের পোশাক ঢুকিয়ে রেখেছেন ব্যাগে। জুতাও রেখেছেন চোখের কিছুটা আড়ালে। তোশকের নিচ থেকে জামাকাপড় বের করতে করতে বলেন, ‘চোখের সামনে ছেলের জামাকাপড় দেখলে বুক জ্বলে।’
ঠিক একই কারণে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে গিয়ে যখন ছেলের লাশ পেয়েছেন, তখনো ভালো করে লাশের দিকে তাকাতে পারেননি আবুল খায়ের। তিনি বলেন, ‘তাকাইতে পারি নাই লাশের দিকে। শুধু একবার দেখছি মাথা ব্যান্ডেজ করা। সন্তান তো। আমি পালছি। লাশের দিকে তাকালে আর্তনাদ বাড়ে। যে মা–বাবার কোল থেকে সন্তান চলে গেছে, শুধু তাঁরাই বুঝতে পারবেন এ কষ্ট।’
আবুল খায়েরের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। সেখানেই থাকেন স্ত্রী পারভীন আক্তার। মায়ের কাছ থেকে রাকিব ঢাকায় পড়তে এসেছিল আড়াই বছর আগে। তার পর থেকে বাবার সঙ্গে থাকত। রাকিব অন্য কারও হাতের রান্না খেতে পছন্দ করত না বলে আবুল খায়ের নিজেই রান্না করতেন। দুই ছেলেকে নিয়ে মেঝেতে বসে খেতেন। দুই ছেলে বিছানায় ঘুমাত, আর তিনি মেঝেতে মাদুর পেতে ঘুমাতেন।
রাকিব মারা যাওয়ার পর তাকে লক্ষ্মীপুরে দাফন করা হয়েছে। আবুল খায়ের ঢাকায় ফিরে কাজে যোগ দিয়েছেন। রাকিবের মা, বড় ভাই ও বিবাহিত বড় বোন জান্নাতুল ফেরদৌস লক্ষ্মীপুরেই আছেন। ঢাকার এক রুমে ভাড়া বাসাটি এখন ফাঁকা। শূন্য পড়ে থাকে খাট। তারপরও আবুল খায়ের মেঝেতেই ঘুমাচ্ছেন। বললেন, খাটে ঘুমাতে গেলেই ছেলের কথা মনে পড়বে।
আবুল খায়ের বলেন, ১৯ জুলাই তিনি বাইরে গিয়েছিলেন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকেও ফোনে রাকিবের সঙ্গে কথা হয়। তখন সে ঘরেই ছিল। তারপর বাইরে বের হয়ে যায়। তিনি ভেবেছিলেন, খেলা শেষে ছেলে ফিরে আসবে। তবে মাগরিব পেরিয়ে এশার নামাজের আজান হয়ে গেলেও ফেরেনি রাকিব। এরপর তিনি খুঁজতে বের হন। একপর্যায়ে মোহাম্মদপুরের সিটি হাসপাতালে যান। সেখান থেকে চিকিৎসকেরা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে যেতে বলেন। ওই হাসপাতালেই ছেলের লাশ পান তিনি।
আবুল খায়ের বলেন, ছেলের লাশ পাওয়ার পর মোহাম্মদপুর থানা ও শেরেবাংলা নগর থানায় দৌড়াতে হয়। ময়নাতদন্তসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষে হাসপাতাল থেকে ছেলের লাশ বের করতে শনিবার দিন পার হয়ে যায়। তারপর ১৫ হাজার টাকায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ছেলের লাশ নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেন।
এখনো বিভিন্ন থানা থেকে দফায় দফায় ফোন আসছে। ছেলে কীভাবে মারা গেল, সে তথ্য জানাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন আবুল খায়ের। ছেলে মারা যাওয়ার পর কোনো মামলাও করেননি। তিনি বলেন, ‘আমার তো কোনো শত্রু ছিল না। ছেলেকে কে, কীভাবে মারল, তাই তো জানি না। ছেলে হত্যার মামলা করব কার বিরুদ্ধে? বিচার কার কাছে চাইব?’
বড় ভাইয়ের তুলনায় পড়াশোনায় ভালো ছিল রাকিব। ভাইয়ের কাছে কম্পিউটার শেখা শুরু করেছিল। আবুল খায়ের রাকিবকে প্রকৌশলী বানানোর স্বপ্ন দেখতেন। গ্রামের পরিবেশে পড়াশোনা ভালো হবে না বলে তাকে ঢাকায় এনেছিলেন। স্কুল ও কোচিংয়ে তিনি নিজেই নিয়ে যেতেন। বেতনের টাকায় সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তারপরও চাইতেন ছেলেদের পড়াশোনায় যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।
মা ছাড়া ছোট ছেলেটা ঢাকায় এসে রয়েছে বলে রাকিবকে একটু বেশিই আদর করতেন আবুল খায়ের। কখনো রাগারাগি করতেন না। রাকিবও খুবই মিশুক ছিল। স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে এলাকার অন্যরাও তাকে আদর করতেন। আবুল খায়ের বলেন, ‘এখন যদি কেউ আমারে কোটি টাকাও দেয়, সেই টাকা দিয়া আমি কী করব? পৃথিবীতে সন্তান হলো সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমার সেই সম্পদই তো চলে গেছে। কেউ তো তাকে আর ফেরত দিতে পারবে না।’