বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান প্রথম দফায় ১৬৬৩ থেকে ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সুবাদারের দায়িত্ব পালন করে। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, তাঁর এই দায়িত্ব পালনকালেই মসজিদটি নির্মিত হয়। নাম দেওয়া হয় ‘শায়েস্তা খান মসজিদ’
আমগাছের একটি শাখা নুয়ে পড়েছে ছাদের ওপর। বুড়িগঙ্গার বুক ছুঁয়ে আসা বাতাসে দুলতে থাকা পাতাগুলো যেন পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছিল ছাদের গম্বুজ। পরপর তিনটি গম্বুজের মধ্যে মাঝখানেরটি বড়। উভয় পাশের একই আকারের গম্বুজ দুটি একটু ছোট।
এককালে এই গম্বুজের শীর্ষে পদ্মপাপড়ির নকশা অলংকৃত ছিল। তখন এর রং ছিল সাদা। সংস্কার করার পর সেই নকশা নেই, রং বদলে করা হয়েছে সবুজ। এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন বাংলার বিখ্যাত সুবাদার—যাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত, সেই শায়েস্তা খান।
খুব সুন্দর স্থাপত্যরীতির এই মসজিদকে এখন সহজে দেখার উপায় নেই। সুবাদার নিজে ছিলেন একজন উঁচুমানের স্থপতি। ঢাকায় লালবাগের কেল্লার পরীবিবির মাজারসহ বেশ কিছু স্থাপনা তার স্থাপত্যশৈলীর সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই মসজিদ তিনি তৈরি করেছিলেন বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে। তখন নদীতীরের এই চমৎকার স্থাপনা নিশ্চয়ই বহুদূর থেকে চোখে পড়ত। এখন তিন পাশ থেকে গজিয়ে ওঠা বহুতল ভবনের সাঁড়াশি আক্রমণে এর রুদ্ধশ্বাস অবস্থা।
প্রায় ৩০ বছর ধরে এই মসজিদে ইমামতি করছি। এর আগে ১৯৫৩ সাল থেকে বাবা মরহুম মাওলানা বেলাল চৌধুরী ইমামতি করতেনমোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম সিদ্দিকী, শায়েস্তা খান মসজিদের ইমাম
শায়েস্তা খান মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৪ দশমিক ৩ মিটার এবং প্রস্থ ৭ দশমিক ৬২ মিটার। এর ছাদে তিনটি গম্বুজ এবং চার কোণে চারটি ও সামনের দেয়ালে দুটিসহ মোট ছয়টি অষ্টভুজাকৃতির অলংকৃত বুরুজ রয়েছে। ভেতরে পশ্চিমের দেয়ালে তিনটি খিলান এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে চারটি খিলান রয়েছে। মসজিদের প্রবেশপথ ছিল পাঁচটি। সামনের অর্ধগম্বুজ আকৃতির খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ এবং উত্তর–দক্ষিণে খিলানযুক্ত দুটি প্রবেশপথ ছিল। এই দুটি প্রবেশপথ ১৯৭১ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে সেখানে জানালা তৈরি করা হয়েছে। এই মসজিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এর মেহরাব (ইমামের দাঁড়ানোর স্থান) মসজিদের মূল দেয়ালের ভেতরেই প্রক্ষিপ্ত অবস্থায় রয়েছে। সাধারণত মসজিদের মেহরাব পশ্চিম দেয়ালের বাইরের দিকে প্রক্ষিপ্ত থাকে।
গতকাল শুক্রবার এবারের মাহে রমজানের প্রথম জুমার জামাত হলো ঢাকার অন্যতম প্রাচীন এই মসজিদে। মসজিদের ভেতরে চারটি কাতার। প্রতিটিতে ২৫ জন মুসল্লি দাঁড়াতে পারেন। মূল মসজিদে এক শ জনেরই নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা ছিল। পরে বারান্দা সম্প্রসারণ করা হয়েছে, সেখানে আরও তিন কাতার এবং বারান্দার ওপরে দুই কাতারের জায়গা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে নিচে ভেতরে-বাইরে মিলে ১৭০ থেকে ১৭৫ জন এবং ওপরে আরও ৪০-৪৫ জন নামাজে অংশ নিতে পারেন।
শায়েস্তা খান মসজিদে একটি বৈদ্যুতিক পাখা চলছে। ১৯৬৭ সালে ৫৩ টাকায় কেনা এই পাখার ওজন ১৫ কেজি
পবিত্র জুমার খুতবায় মাহে রমজানের ফজিলত নিয়ে আলোচনা করলেন খতিব মুফতি শফিকুল ইসলাম। নামাজে যাঁরা অংশ নিলেন, তাঁদের অধিকাংশই মিটফোর্ড হাসপাতালের কর্মী ও ভর্তি থাকা রোগীদের সঙ্গে আসা আত্মীয়স্বজন।
নামাজ শেষে মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি এই মসজিদের ইমামতি করছেন। এর আগে ১৯৫৩ সাল থেকে তাঁর বাবা মরহুম মাওলানা বেলাল চৌধুরী ইমামতি করতেন।
ইমাম মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম সিদ্দিকী জানান, এই মসজিদ ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় একবার অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার তখন সংস্কার করার সময় মসজিদের স্থাপত্যের বেশ কিছু পরিবর্তন হয়। পরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মসজিদের ওয়াক্ফ সম্পত্তির মধ্যে দুই-তিনটি দোকান আছে। সেই আয়ে মসজিদটি চলে। তবে কোনো দিন এখানে নামাজ বন্ধ হয়নি। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যায় প্রায় ৫ ফুট পানি উঠেছিল মসজিদে। ডেকোরেটরের টেবিল ভাড়া এনে মঞ্চ তৈরি করে নামাজ হয়েছে।
শায়েস্তা খান মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৪.৩ মিটার এবং প্রস্থ ৭.৬২ মিটার। এর ছাদে তিনটি গম্বুজ এবং চার কোণে চারটি ও সামনের দেয়ালে দুটিসহ মোট ছয়টি অষ্টভুজাকৃতির অলংকৃত বুরুজ রয়েছে
মসজিদের ভেতরে একটি বেশ পুরোনো একটি বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে। ইমাম মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম সিদ্দিকী জানান, ১৯৬৭ সালে ৫৩ টাকায় কেনা ফ্যানটির ওজন ১৫ কেজি। সেটি এখনো চলছে।
প্রতিবছরের মতো এবারও রমজানের চাঁদ ওঠার পর থেকে শুরু হয়েছে খতম তারাবিহর নামাজ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রায় ৩০ জনের মতো রোজাদারকে ইফতারি করানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে মসজিদের ইমাম আক্ষেপ করে বললেন ‘এত সুন্দর প্রাচীন মসজিদটি এখন আর সামনে পেছনে কোনো দিক থেকেই চোখে পড়ে না! যাঁরা ইতিহাস ঐতিহ্যের অনুরাগী, তাঁদের কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে মসজিদ দেখতে আসেন, নামাজে অংশ নেন।’
শায়েস্তা খান মসজিদটি পড়ে গেছে মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছনে। মূল মসজিদটি উত্তর–দক্ষিণে লম্বা। প্রবেশপথ পূর্ব দিকে। এর উত্তর পাশে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল ও মিটফোর্ড হাসপাতালের ১১ তলা ভবন। পশ্চিমে ছয়তলা নার্সেস ডরমিটরি ও পূর্ব পাশে নারী ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ছয়তলা হোস্টেল। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার পাড় দিয়ে নির্মিত শহর রক্ষা বাঁধ দিয়ে বাদামতলীর আড়তের দিকে চলছে পণ্যবোঝাই ট্রাক আর যাত্রাবাহী লেগুনা। ফলে হাসপাতালের পেছনের গলি দিয়ে সামনে গিয়ে না দাঁড়ালে একতলা মসজিদটির দেখা পাওয়ার উপায় নেই।
‘বাংলা পিডিয়া’, মুনসি রহমান আলী তায়েশের ‘তাহরিখে ঢাকা’, মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থসহ বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যাচ্ছে, এই মসজিদ সুবাদার শায়েস্তা খান নির্মাণ করলেও নির্মাণের সঠিক সময় অজানা। মসজিদের গায়ে ফারসি ভাষায় লেখা যে শিলালিপিটি উৎকীর্ণ আছে, তা পুরোপুরি পড়া যায় না। যেটুকু পড়া গেছে, তা থেকে জানা যায়, মসজিদটি সুবাদার শায়েস্তা খান নির্মাণ করেছিলেন এবং মসজিদটি তিনি ওয়াক্ফ করেছেন। এই সম্পত্তির আয় মসজিদের সেবায় ব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। শায়েস্তা খান প্রথম দফায় ১৬৬৩ থেকে ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সুবাদারের দায়িত্ব পালন করেন। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, শায়েস্তা খানের দায়িত্ব পালনকালেই মসজিদটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন।
শায়েস্তা খান মসজিদের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। তা হলো, অনেক সময় মিটফোর্ড হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে আসা আত্মীয়রা কোনো কারণে কোথাও রাতে থাকার ব্যবস্থা করতে না পারলে মসজিদে রাতে থাকতে পারেন। সুবাদার শায়েস্তা খান তাঁর নির্দেশনায় বলেছিলেন, এই মসজিদে যাঁরা নামাজ পড়াবেন, খেদমত করবেন; সবাই অতীত–বর্তমানের সবার জন্য দোয়া করবেন, আর মুসাফিররা এখানে নামাজ আদায়ের পাশাপাশি থাকতেও পারবেন। সেই ঐতিহ্য এখনো রয়েছে।
এ ছাড়া হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সম্প্রসারণ করার আগে অনেক সময় কোনো বিশেষ কারণে হঠাৎ রোগীর সংখ্যা বেশি হলে এই মসজিদের বারান্দা বা ভেতরে তাঁদের রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এমন দুটি বড় ঘটনার কথা জানান ইমাম আবদুল কাইয়ুম। ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইলের সাটুরিয়ায় দিনের বেলা প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে বহু মানুষ হতাহত হয়েছিলেন। আর ২০০৭ সালে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার মাঠে ঘূর্ণিঝড়ে বহু মুসল্লি আহত হয়েছিলেন। তাঁদেরও মিটফোর্ড হাসপাতালে আনা হয়েছিল। একসঙ্গে এত রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার মতো স্থান তখন জরুরি বিভাগে ছিল না। শায়েস্তা খান মসজিদে রেখে অনেককে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল।
নবাব শায়েস্তা খান দুই দফায় প্রায় দুই দশকের বেশি সময় বাংলা শাসন করেছেন। ঢাকাকে তিনিই স্থাপত্য, ব্যবসা-বাণিজ্যে, সুশাসনে একটি সমৃদ্ধ শহরে পরিণত করে তুলেছিলেন। পর্তুগিজ দস্যুদের পরাস্ত করে নিরাপদ করেছিলেন বাঙালিদের জীবনযাত্রা। কিন্তু এই শহরবাসী কী আর তাঁকে সেভাবে স্মরণে রেখেছে!