সম্প্রতি আশ্রয়শিবিরে কয়েকজন মাঝিকে (নেতা) হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
গতকাল বালুখালী শিবিরে মোহাম্মদ হোসেন নামের এক রোহিঙ্গা মাঝিকে হত্যা করা হয়েছে।
গত চার মাসে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৬ জন।
কক্সবাজারের উখিয়ার আশ্রয়শিবিরগুলোতে আতঙ্কে ভুগছেন অন্তত ৭০০ রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা)। এর মধ্যে ৯০ জনের মতো মাঝি এরই মধ্যে আত্মগোপনে চলে গেছেন। সম্প্রতি আশ্রয়শিবিরের কয়েকজন মাঝিকে হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
সর্বশেষ গতকাল সোমবার সকাল ১০টার দিকে বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) গুলি করে মোহাম্মদ হোসেন (৩০) নামের এক রোহিঙ্গা মাঝিকে হত্যা করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মি’র (আরসা) ১০-১২ জনের একটি দল তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে একই শিবিরে আরসার লোকদের গুলিতে এক শিশুসহ চার রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হন।
পুলিশের তথ্য বলছে, গত চার মাসে আশ্রয়শিবিরে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে ২০টির বেশি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় ১৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজন আরসার সদস্য এবং আটজন রোহিঙ্গা মাঝি। বাকিরা সাধারণ রোহিঙ্গা।
এসব হত্যার ঘটনায় মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসার প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনিসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন আরসার পাঁচজনও। তবে এতে আতঙ্ক কমছে না।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। সম্প্রতি ক্যাম্প ঘুরে নানা বয়সী নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশ্রয়শিবিরের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে ঘিরে আরসার সঙ্গে মাদক চোরাচালানের গডফাদার হিসেবে পরিচিত রোহিঙ্গা নবী হোসেন বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি, সংঘর্ষ ও খুনাখুনির ঘটনাগুলো ঘটছে।
বালুখালী আশ্রয়শিবিরে একটি ব্লকে তিন বছর ধরে সাব-মাঝির কাজ করা এক রোহিঙ্গা কয়েক দিন ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে পেলে আরসার লোকেরা গুলি করে মারবে। কারণ, তিনি কয়েক মাস আগে আরসা ত্যাগ করে নবী হোসেনের বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন।
আত্মগোপনে চলে যাওয়া আরও কয়েকজন মাঝি জানান, আশ্রয়শিবিরের মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে নবী হোসেন বাহিনী। এতে জড়িত বেশ কয়েকজন মাঝি। আগে মাঝিদের মাধ্যমে আরসা মাদক চোরাচালানে ভাগ বসাত, মাদক কারবারি ও দোকানপাট থেকে চাঁদা আদায় করত। এখন সেটি সম্ভব হচ্ছে না দেখে আরসা মাঝিদের হত্যার ‘মিশনে’ নেমেছে তারা। উদ্দেশ্য, মাঝিরা যেন আরসা ত্যাগ না করেন এবং নিয়মিত মাসোহারা আদায় করে দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, সন্ধ্যার পর আরসার লোকেরা মাঝিদের আস্তানা ও ঘরে গিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। এতে নবী হোসেন বাহিনীর সমর্থক অন্তত ৭০০ মাঝি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
আশ্রয়শিবিরে খুনখারাবি বৃদ্ধি পাওয়ায় আতঙ্কে আছেন শরণার্থীদের মানবিক সেবায় নিয়োজিত দেশি ও আন্তর্জাতিক এনজিওর কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। অনেক এনজিও সেবা কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মুহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর রাখা হয়েছে। খুনখারাবি বেড়ে যাওয়ায় আশ্রয়শিবিরে সেবাদানকারী লোকজনের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক কাজ করছে ঠিক, আমরা সেসব কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি।’
আশ্রয়শিবির পরিচালনা ও শরণার্থীদের তদারকির জন্য মাঝিদের নেতৃত্বে গঠন করা হয় ‘ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটি’। প্রতিটি আশ্রয়শিবিরে ৪০ থেকে ১২০ জন হেড মাঝি ও সাব-মাঝি নিযুক্ত করে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে হেড মাঝি ও সাব-মাঝির সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার।
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, শুরুর দিকে (২০১৮ সালে) ৮০ শতাংশ মাঝিকে নিয়ন্ত্রণ করত আরসা। দেড় বছর আগে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর অধিকাংশ মাঝি আরসা ত্যাগ করেন। মাঝিদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নবী হোসেনের বাহিনীতে যোগ দেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যমতে, আশ্রয়শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের ১৪টি বাহিনী রয়েছে। এর মধ্যে নয়টি নবী হোসেন বাহিনীর এবং ছয়টি আরসার নিয়ন্ত্রণে।
পুলিশের তথ্য বলছে, ৮ এপিবিএনের অধীনে আছে উখিয়ার ১১টি আশ্রয়শিবির। ১৪ এপিবিএনের অধীনে ১৫টি। এই ২৬ আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা আছে সোয়া ৯ লাখ। টেকনাফের সাতটি আশ্রয়শিবিরে থাকে সাড়ে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
জানতেচাইলে৮এপিবিএনেরমুখপাত্রওসহকারীপুলিশসুপার (অপারেশনওমিডিয়া) মো. ফারুকআহমেদবলেন, আশ্রয়শিবিরেএকাধিকরোহিঙ্গাসন্ত্রাসীগোষ্ঠীতৎপররয়েছে।সন্ত্রাসীদেরধরতেঅভিযানচলছে।