ঈদের ছুটি কাটাতে গত বৃহস্পতিবার থেকেই অনেকে রাজধানী ছাড়তে শুরু করেন। ঈদযাত্রার প্রথম কয়েক দিন সড়ক ও ট্রেনযাত্রায় স্বস্তি ছিল। তবে সোম ও মঙ্গলবার ছিল ভিন্ন চিত্র। এই দুই দিন ঈদে বিভিন্ন গন্তব্যে বাড়ি ফেরা মানুষের চাপ বাড়ে। ফলে ঢাকা ছাড়তে গিয়ে বিশেষ করে উত্তরবঙ্গগামী যাত্রীদের যানজটে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ট্রেনের ছাদে ও অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে ঝুঁকি নিয়ে ঝুলে গন্তব্যে পৌঁছান অনেকে। তবে আজ বুধবার বাড়ি ফেরা মানুষের তেমন দুর্ভোগ হয়নি।
পরিবহন খাত নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, এবারও যানবাহনের অভাবে মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। সড়কে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং উন্নয়নকাজের কারণে মহাসড়কে যানজটে পড়তে হয়। ট্রেনের ছাদে যাত্রী ওঠার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করলেও যাত্রীর চাপে তা পুরোপুরি মানা সম্ভব হয়নি। তবে কয়েকটি গন্তব্য ছাড়া সার্বিকভাবে এবার ঈদযাত্রা অন্যান্য বছরের তুলনায় স্বস্তির হয়েছে।
সরকারের মন্ত্রী-আমলারা ঈদযাত্রায় সড়কপথে স্বস্তির আশার কথা শুনিয়েছিলেন। ঈদে যানজট ও ঘরমুখী মানুষের ভোগান্তি হতে পারে-এমন ১৫৫টি স্থানও চিহ্নিত করা হয়। উত্তরাঞ্চলের ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ কমাতে ৬ এপ্রিল একটি রেল ওভারপাস, সাতটি সড়ক ওভারপাস ও দুটি সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের সাতটি ওভারপাস খুলে দেওয়া হয়।
সাধারণত ঈদের আগের দু-তিন দিন বাড়ি ফেরা মানুষের চাপ বেশি থাকে। বিশেষ করে পোশাক কারখানা ছুটির পরই মূল চাপটা পড়ে। এবারও তেমনটাই দেখা গেছে। গত সোমবার বিকেলে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকার পোশাক কারখানা ছুটি হয়। ফলে সেদিন রাত থেকেই ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের চাপ বেড়ে যায়। উত্তরবঙ্গের যাত্রায় ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বেশ কয়েকটি জায়গায় সোমবার দিবাগত রাত থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ছিল যানজট।
গণপরিবহনের সংকট ও ভাড়া নৈরাজ্য রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ব্যবস্থাপনায় আরেকটু গুরুত্ব দিলে ভবিষ্যতে ঈদযাত্রা হবে আরও আনন্দদায়ক ও স্বস্তির।মো. হাদিউজ্জামান, অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানের ২০২৩ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ঈদের আগের চার দিন দৈনিক গড়ে ৩০ লাখ মানুষ বাড়ি যান। কিন্তু ঢাকাকেন্দ্রিক যে গণপরিবহনব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো দিয়ে বড়জোর দিনে ২২ লাখ লোক পরিবহন সম্ভব। আরও ৮ লাখ মানুষ ট্রাক, অটোরিকশাসহ নানা অপ্রচলিত বাহনে ভোগান্তি নিয়ে যাতায়াত করেন।
এবারও সে চিত্রের ব্যতিক্রম ছিল না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েও অনেক যাত্রী বাস পাননি। বাস না পেয়ে কেউ ট্রাকে, কেউ পিকআপ ভ্যানে, কেউ অটোরিকশায় দূরের পথ ধরেন। মানুষের চাপের সুযোগে বরাবরের মতো এবারও বাসে বাড়তি ভাড়াও আদায়ের অভিযোগ ওঠে।
এবারের ঈদে ট্রেনযাত্রায় ছাদে যাত্রী ওঠা বন্ধে কর্তৃপক্ষ নানা ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু সোমবার বিকেল ও মঙ্গলবার সারা দিন কমলাপুর রেলস্টেশনে তৈরি হয় বিশৃঙ্খল অবস্থা। ঠাসাঠাসি করে যাত্রী নিয়ে সকাল থেকে চলে ট্রেন। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের কোনো ট্রেনের ভেতরে, ছাদ ছিল যাত্রীবোঝাই। লালমনিরহাটগামী বুড়িমারী এক্সপ্রেস, পঞ্চগড়গামী একতা এক্সপ্রেস, রংপুরগামী রংপুর এক্সপ্রেস, রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড় ছিল। কয়েকটি ট্রেন ছাড়েও দেরিতে। তবে আগে যেমন ঈদযাত্রায় রেলের শিডিউল বিপর্যয় ছিল নিয়মিত ব্যাপার, এবার তেমনটা খুব বেশি দেখা যায়নি।
ঈদযাত্রার শুরুর দিকে লঞ্চে বাড়তি ভিড় ছিল না। তবে ঈদ ঘনিয়ে আসতে দক্ষিণের জেলাগুলোর লঞ্চেও যাত্রীদের চাপ বাড়ে। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঈদে ঘরে ফেরা যাত্রীদের চাপ থাকায় যাত্রী বোঝাই করেই লঞ্চগুলো ঘাট থেকে ছেড়ে যায়। লঞ্চের ছাদে যাত্রী ওঠায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হয়নি।
সার্বিক ঈদযাত্রার বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এবারের ঈদযাত্রায় দুটি বিষয় ছিল চোখে পড়ার মতো। আগে চার-পাঁচ দিন ধরে মহাসড়কে যানজট থাকত, এবার সেটা দেড় দিনে নেমে এসেছে। আর মহাসড়কে যানজটের স্পট (জায়গা) অনেক কমে এসেছে। ফলে গত কয়েক বছরের তুলনায় স্বস্তিদায়ক ছিল। তিনি বলেন, গণপরিবহনের সংকট ও ভাড়া নৈরাজ্য রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ব্যবস্থাপনায় আরেকটু গুরুত্ব দিলে ভবিষ্যতে ঈদযাত্রা হবে আরও আনন্দদায়ক ও স্বস্তির।