মুঠোফোনে গুগলের মাধ্যমে নিজের এলাকার বন্যার আগাম তথ্য পাবেন মানুষ। এতে নিজেদের জানমাল রক্ষায় আগাম প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হবে।
‘মনে হচ্ছে জোরেশোরে বৃষ্টি নামবে। এক ফোঁটা ফসলও এখনো ঘরে তুলতে পারি নাই। এবারও না বানের পানিতে সব ফসল ভাসি যায়।’ গত ১ মে নিজের মনে কথাগুলো বলছিলেন কৃষক আবসার আলী। ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার নিতাইপুর গ্রামে বংশপরম্পরায় তাঁদের বসবাস। বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিপাত ও সম্ভাব্য বন্যা মে মাসের শুরুতেই তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল।
কারণ, জুলাইয়ের শেষে বা আগস্টের শুরুতে প্রায় প্রতিবছরই বন্যায় তাঁদের এলাকা ডুবে যায়। ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে তাঁরা বুঝতে পারেন না, কবে বন্যার পানি তাঁদের এলাকায় ঢুকে পড়বে। কখন ফসল কেটে ঘরে তুলে ক্ষতি কমানো যাবে।
বন্যার ভয় আর ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকা আবসার আলীর কাছে নতুন এক সমাধান নিয়ে হাজির হলো তাঁর ১৫ বছর বয়সী ছেলে আসমত আলী। বাবার কাছে এসে বলল, ‘কী হইল বাবা, মাথায় হাত দিয়া কী চিন্তা করো?’ বাবা বন্যা আর ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা বলতেই ছেলে বলল, ‘এইবার থেকে তোমারে বন্যার খবর দিবে গুগল।’ কিশোর আসমতের মুখে আনন্দের হাসি। নবম শ্রেণিতে পড়লেও আসমতের বুদ্ধি বেশ তীক্ষ্ণ। সমসাময়িক, বিশেষ করে প্রযুক্তিগত বিষয়ে তার যথেষ্ট আগ্রহ আছে।
—‘কী কস! বুঝলাম না।’ অবাক চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন আবসার আলী।
ছেলে জবাব দিল, ‘হ বাবা। ইন্টারনেটে গুগল নামে একটা জিনিস আছে। যেখানে সবকিছুর খবর পাওয়া যায়। সরকার এই গুগলের মধ্যে দেশের বন্যার খবরও ঢোকানোর ব্যবস্থা করছে। তোমার মোবাইলে ইন্টারনেট আর গুগল থাকলে সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস থেকে বন্যার খবর তোমারে দিনে দুইবার করে দিবে।’
—‘কে এই খবর দিব? আর এই খবর যে সত্যি, তা কেমনে বুঝব?’ আবসার আলীর প্রশ্ন।
—‘সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র থেকে বন্যার আগাম খবর এই গুগলের মাধ্যমে তুমি পাইবা। তুমি এই খবরে ভরসা রাখতে পারো।’ ছেলের তাৎক্ষণিক জবাব।
‘তুই এত কিছু জানলি কেমনে?’ বাবার প্রশ্ন।
—‘আমাগো স্কুলে রেড ক্রিসেন্টের লোক আইছিল। তারা মোবাইল দিয়া আমাগো শিখাইছে কীভাবে বন্যার বিভিন্ন তথ্য, আগাম সতর্কবার্তা ইত্যাদি সহজে পাওয়া যায়।’ আসমত তার বাবাকে বলে।
—‘কিন্তু বাবা, আমি তো ইন্টারনেট বা গুগল কিছুই বুঝি না, মোবাইলে খালি কথা কই।’ ছেলের কাছে বাবার হতাশামাখা উত্তর।
—‘বাবা, চিন্তা কইরো না, আমি জানি, ওদের কাছ থেকে শিখে নিছি, খুব সোজা। আমি তোমারে শিখাইয়া দিব।’ বাবাকে আশ্বস্ত করে ছেলে
আসমত বলে।
২০২০ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ সেবা চালু করেছে সরকার। ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পাউবোর তত্ত্বাবধানে এই কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এ ব্যবস্থায় পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ দপ্তর থেকে তৈরি বন্যা পূর্বাভাস তথ্য-উপাত্ত গুগল বন্যা সতর্কীকরণে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেবাগ্রহীতাকে জানানো হয়।
তথ্যপ্রযুক্তির গতিময় অগ্রযাত্রার এই যুগে বিশ্বের জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগলের (Google) ওপর মানুষ অনেকাংশেই নির্ভরশীল। গুগল এমন এক নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তিতে পরিণত হয়েছে, যা শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর মানুষের মৌলিক চাহিদা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সরকারি নীতিনির্ধারণে তথ্যসেবা দিয়ে থাকে। এই সার্চ ইঞ্জিন যে শুধু মানুষের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি খাতে সেবা দিচ্ছে, তা নয়; একই সঙ্গে নানা দুর্যোগে মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করছে। মানুষের জানমালেরÿক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
‘Google Flood Alert’ (গুগল ফ্ল্যাড অ্যালার্ট) পরিষেবা একটি অত্যাধুনিক এবং সহজলভ্য প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণসহ বন্যার আগাম বার্তা পাওয়া সম্ভব। ভারতসহ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ বন্যা পর্যবেক্ষণে গুগলের এই প্রযুক্তি বেশ আগে থেকে ব্যবহার করছে। বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ বার্তা দিতে বাংলাদেশে প্রায় দুই বছর ধরে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। গত মে ও জুন মাস মিলিয়ে দেশের প্রায় ২৩ লাখ ২০ হাজার মানুষকে গুগল এই সেবা দিয়েছে। গুগল তাদের দিনে দুবার করে নিজ নিজ এলাকার বন্যার আগাম পূর্বাভাস দিয়েছে। বন্যার পানি তাদের এলাকা থেকে কত দূরে আছে, কত সময়ের মধ্যে তা বিপৎসীমার কাছাকাছি পৌঁছাবে, কখন বন্যায় তাদের এলাকা ডুবে যাবে—গুগল ফ্লাড অ্যালার্টে এসব তথ্য জানা যাচ্ছে।
মানুষকে বন্যা বা আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে তথ্য পেতে একসময় দৈনিক পত্রিকা ও সরকারি দপ্তরগুলোর ওপর নির্ভর করতে হতো। এখন গুগল ফ্লাড অ্যালার্টের মাধ্যমে যেকোনো নাগরিক সহজে এসব তথ্য পেতে পারেন। এতে বন্যার আগে প্রস্তুতি নেওয়ার পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়। দ্রুত পরিবারের বয়স্ক ও শিশুদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় সম্পদ ও সামগ্রী নিরাপদে রাখার মতো কাজ সেরে নেওয়া যায়।
বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস পরিষেবা গুগলের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছাতে সরকার ২০১৮ সালে প্রথম চেষ্টা শুরু করে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ দপ্তর, সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সংস্থা এটুআই এবং আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা গুগল যৌথভাবে এ কার্যক্রম শুরু করে। ২০২০ সালে ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থা’ পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। ২০২০ ও ২০২১ সালে বন্যা মৌসুমে পরীক্ষামূলক কাজ সফলভাবে শেষ হয়। ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পাউবোর তত্ত্বাবধানে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রমটির যাত্রা শুরু হয়।
বন্যা সতর্কীকরণ ব্যবস্থায় পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ দপ্তর থেকে তৈরি আগাম পাঁচ দিনের বন্যা পূর্বাভাস উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। এরপর ভূ-উচ্চতার তথ্য ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির মাধ্যমে গুগলের সহযোগিতায় স্থানীয় পর্যায়ে প্লাবন মানচিত্র প্রস্তুত ও প্রচার শুরু হয়। এর মাধ্যমে বন্যাকালে অথবা বন্যা শুরুর তিন দিন থেকে তিন ঘণ্টা সময় আগে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন ধরনের পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ বার্তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
বন্যা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি-বেসরকারি পেশাজীবী ও গণমাধ্যম কর্মীরা পাউবোর বিদ্যমান বন্যা পূর্বাভাস সেবার তথ্য ব্যবহার ও প্রচারের ব্যবস্থা নিতে পারেন। বর্তমানে দেশের ৫৫টি উপজেলার মানুষ এই পরিষেবার সুবিধা নিতে পারছে। তবে এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক প্রচারণা ও জনসম্পৃক্ততা। এবারের বন্যা মৌসুমেও সেবাটি সচল রয়েছে।
বাংলাদেশের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। দুর্যোগপ্রবণ এলাকার দুস্থ ও অসহায় মানুষের জানমাল রক্ষায় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। দুর্যোগ-পূর্ববর্তী সময়ে সতর্কতার বার্তা প্রচারের পাশাপাশি দুর্যোগকালে ও দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে দুর্গম, অসহায় ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে থাকে। এই প্রতিষ্ঠান ২০২১ সাল থেকে গুগলের বন্যা সতর্কীকরণব্যবস্থা সাধারণ মানুষ ও বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রচার করে আসছে। গুগলের বন্যা সতর্কীকরণব্যবস্থা মানুষের মধ্যে প্রচারে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কাজ ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
বন্যার পূর্বাভাস ও বন্যা সতর্কীকরণ বার্তা পেতে হলে প্রথমে ইন্টারনেট সংযোগসহ অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে লোকেশন অন করতে হবে। বন্যার তথ্য পেতে গুগল সার্চ বারে ইংরেজিতে নিজের উপজেলার নাম লিখে স্পেস দিয়ে flood লিখতে হবে। যেমন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার বন্যার তথ্য পেতে ‘Beanibazar flood’, সদর উপজেলার তথ্য পেতে ‘Sylhet flood’ ইত্যাদি লিখতে হবে।
পাউবোর নিকটস্থ গেজ রিডারে পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলে স্থানটি বন্যা আক্রান্ত নয় বলে গণ্য হবে এবং কোনো বার্তা পাওয়া যাবে না। দেশের সব বন্যা সতর্কীকরণ বার্তা একযোগে দেখা যাবে http://g.co/floodalerts এই ওয়েবসাইটে। ব্যবহারকারী পর্যায়ে অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া অন্য কোনো চার্জ প্রযোজ্য হবে না।
গুগল অ্যালার্টের মাধ্যমে পানির স্তরের উত্থান-পতন, বন্যার গভীরতা, তীব্রতাসহ বন্যার অঞ্চল–সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যাবে। গুগল ম্যাপের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার বন্যা সতর্কতার ভিত্তিতে প্লাবনের নিয়মিত হালনাগাদ দৃশ্যপট দেখা যাবে। গুগল অনুসন্ধানে বন্যাসম্পর্কিত নানা তথ্য ও পরামর্শ যেমন—সুরক্ষা, ফসল তোলা, বন্যার অ্যাপ্লিকেশন, জরুরি সরবরাহের তথ্য পাওয়া যাবে।
প্লাবনের দৃশ্যপটের সঙ্গে প্রয়োজনীয় তথ্য যেমন—বন্যার তীব্রতা, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পানির স্তরের বৃদ্ধি,পতন, বন্যাকবলিত অঞ্চল, বন্যার আনুমানিক গভীরতা, সুরক্ষা পরামর্শ এবং জরুরি সেবার যোগাযোগের নম্বর, ঠিকানা ইত্যাদি পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে আগামী সপ্তাহ থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় আবারও বন্যার আশঙ্কা আছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষিনির্ভর ওই এলাকায় বন্যার পানি কখন কোথায় আসবে, তা জানতে হলে গুগলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ অনুসন্ধান করতে পারেন। এ প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করা গেলে সম্পদ ও জীবনরক্ষায় অনেক বেশি কাজ হবে।
গত জুনে সিলেট বিভাগে বন্যার খবর দুই দিন আগে থেকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এবং গুগলের মাধ্যমে দেওয়া শুরু হয়। উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টি শুরুর আগে ১৫ ও ১৬ জুন সিলেট বিভাগের অ্যান্ড্রয়েড ফোনের গ্রাহকদের মধ্যে যাঁরা লোকেশন অন করে এলাকার নাম ও ফ্লাড লিখেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের কাছে ওই পূর্বাভাস যায়। সেখানে দু–এক দিনের মধ্যে বন্যা আসতে পারে বলে জানানো হয়েছিল। এতে বন্যায় কী ধরনের সতর্কতা পালন করতে হবে, সেই নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল।
তবে এখানে বন্যা যে এতটা ভয়াবহ হবে, তা গুগলের সতর্কবার্তায় বলা হয়নি। কারণ, বৃষ্টির পানি উজানের বিভিন্ন স্থানে জমে ছিল। পানির পরিমাণ ও স্রোত বেড়ে যাওয়ায় বন্যা হঠাৎ করে মারাত্মক রূপ নেয়। জমে থাকা পানি একযোগে ভাটিতে সিলেটের দিকে নেমে আসে। এতে ওই এলাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কীভাবে বন্যার আগাম পূর্বাভাস সঠিকভাবে দেওয়া যায়, তা নিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এবং গুগল কাজ করছে।
লেখক: নির্বাহী প্রকৌশলী, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র, পাউবো