এবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। পাশাপাশি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে কয়েক কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
নিজের পাশাপাশি এসব সম্পদ ফয়সালের স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাইসহ আত্মীয়স্বজনের নামে দেখানো হয়েছে। তাঁর সম্পদের বিবরণী গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার আদালতের কাছে তুলে ধরেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফয়সাল ও তাঁর স্ত্রীর নামে থাকা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে ৫ কাঠার দুটি প্লট, শ্বশুরের নামে থাকা ঢাকার রমনা এলাকায় একটি ফ্ল্যাট, খিলগাঁওয়ে শাশুড়ির নামে ১০ কাঠা প্লট জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এই আদেশ দেন।
এ ছাড়া ফয়সাল ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের নামে থাকা ১৯টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৮৭টি হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আদালতের আদেশে বলা হয়, এই জব্দের আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় এসব সম্পদ হস্তান্তর বা বিনিময় করা যাবে না।
এর আগে এনবিআরের সদস্য মো. মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের নামে বিপুল সম্পদ থাকার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ ছাড়া পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পদ থাকার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। বিষয়টি অনুসন্ধান করছে দুদক। বেনজীর ও মো. মতিউর কীভাবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন, তা নিয়ে জাতীয় সংসদে প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সদস্যরাও। তাঁরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এ রকম কর্মকর্তা বর্তমানে আরও থাকতে পারেন।
এনবিআরের কর্মকর্তা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছর দুদক অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। সংস্থাটি প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে গতকাল ফয়সাল ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের নামে সম্পদের বিবরণী আদালতের কাছে তুলে ধরে।
দুদক আদালতকে বলেছে, ২০০৫ সালে কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল বিসিএস (কর) ক্যাডারে সহকারী কর কমিশনার হিসেবে যোগ দেন। তিনি বর্তমানে এনবিআরের আয়কর বিভাগের প্রথম সচিব (ট্যাক্সেস লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট)। তিনি থাকেন রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ফ্ল্যাটে। তাঁর স্থায়ী ঠিকানা খুলনার খান এ সবুর রোডের মুজগলি এলাকায়।
গতকাল রাতে খুলনার খান এ সবুর রোডের মুজগলি এলাকায় গিয়ে জানা যায়, সেখানে ফয়সালদের দ্বিতল বাড়ি রয়েছে। বাড়ির প্রধান ফটক দুটি বন্ধ ছিল। স্থানীয় লোকজন জানান, ফয়সালরা দুই ভাই। মুজগলি নেছারিয়া মাদ্রাসার পাশে তাঁদের আরেকটি বাড়ি আছে। সেখানে তাঁর ভাই ও মা থাকেন। এর বাইরে তাঁদের আরও সম্পদ রয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানান।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে গত রাতে কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ফোন ধরেননি।
আদালতে জমা দেওয়া দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জুনে রাজধানীর ভাটারা এলাকায় ফয়সালের নামে পাঁচ কাঠার একটি প্লট কেনা হয়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাঁর নামে আলাদা চারটি দলিলে জমি কেনা হয়। এসব সম্পদের দলিল মূল্য দেখানো হয় ৪০ লাখ টাকার বেশি।
গত বছর রাজধানীর ভাটারা এলাকায় ফয়সালের স্ত্রী আফসানা জেসমিনের নামে কেনা হয় পাঁচ কাঠার প্লট। প্লট কেনার অর্থ (৭৫ লাখ টাকা) পরিশোধ করা হয়েছে মাহমুদা হাসানের নামে থাকা একটি ব্যাংক হিসাব থেকে। এর চার বছর আগে স্ত্রীর নামে একই এলাকায় আরও পাঁচ কাঠার একটি প্লট কেনা হয়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জেও স্ত্রীর নামে জমি রয়েছে। এসব সম্পদের দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ৪২ লাখ টাকা।
ফয়সালের শ্বশুর আহমেদ আলীর নামে রাজধানীর রমনা এলাকায় গত বছর অক্টোবরে একটি ফ্ল্যাট কেনা হয়, যার মূল্য দেখানো হয় ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে ২০২২ সালে খিলগাঁওয়ে ১০ কাঠার একটি প্লট কেনা হয়। দলিল মূল্য ৫২ লাখ টাকা।
ফয়সাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয়পত্রের বিবরণও আদালতে জমা দিয়েছে দুদক। এতে দেখা যায়, ফয়সাল, তাঁর স্ত্রী ও শ্বশুরের নামে ৫০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এর বাইরে তাঁর স্বজনদের নামেও সঞ্চয়পত্র রয়েছে। দুদক বলেছে, তাঁদের নামে থাকা সঞ্চয়পত্রের মোট অর্থের পরিমাণ ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
ফয়সাল, তাঁর স্ত্রী, শ্বশুর ও তাঁর স্বজনদের ১৯টি ব্যাংক ও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ৬ কোটি ৯৬ লাখ ৫০ হাজার ৯০৮ টাকা।
আদালতের আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আদালতকে জানিয়েছেন, কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে বদলি–বাণিজ্য ও আয়করদাতাদের ভয় দেখিয়ে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আছে। তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অপরাধলব্ধ আয়ের প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা গোপন করে মানি লন্ডারিং অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে।
দুদকের পিপি মোশারফ হোসেন কাজল প্রথম আলোকে বলেন, এনবিআরের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। এ বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে। প্রাথমিকভাবে দুদকের অনুসন্ধান দল ঢাকায় তাঁর ফ্ল্যাট, প্লট, সঞ্চয়পত্রসহ ১৬ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের খোঁজ পেয়েছে। এসব সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার জন্য গতকাল দুদকের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছেন।
অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মো. মোস্তাফিজ আদালতকে লিখিতভাবে জানান, এনবিআর কর্মকর্তা আবু মাহমুদ ফয়সাল সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ লেনদেন করেছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয়ের উৎস গোপনের জন্য নিজের নামসহ তাঁর আত্মীয়স্বজনের নামে ৭০০টির বেশি হিসাব খোলেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে, অপরাধলব্ধ আয়ের উৎস গোপন করা।
সম্প্রতি এনবিআর কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি, ৮টি ফ্ল্যাট, ২টি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং ২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে। তাঁর নামে প্রায় ২৮ বিঘা জমি ও ৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে; এর মধ্যে ঢাকার মিরপুরে একটি ভবনেই রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। সাবেক কলেজশিক্ষক লায়লা কানিজ বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক।
গত পবিত্র ঈদুল আজহার সময় মতিউর রহমানের ছেলে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় আসেন। ছেলের বিলাসী জীবনযাপনের সূত্র ধরে মতিউরের সম্পদের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য প্রকাশের পর জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এবার এনবিআরের আরেক কর্মকর্তার সম্পদ ক্রোকের আদেশে স্পষ্ট হচ্ছে যে সংস্থাটির আরও অনেকে দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার কথা। জমা দেওয়া সম্পদের বিবরণী প্রকাশিত হলে দুর্নীতি কমবে। তবে অসাধু কর্মকর্তা–কর্মচারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হলেই দুর্নীতি আরও কমবে। এ ব্যাপারে সরকার ও দুদক কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, খুলনা]