ঈদে ঘরে ফেরার পাশাপাশি অনেকেই ছুটে যান বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় ছুটি কাটাতে। গত এক দশকে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে এবার মূল্যস্ফীতির চাপ, গরম আবহাওয়া, উড়োজাহাজের চড়া ভাড়া—সব মিলিয়ে আগ্রহ কমেছে পর্যটনে। দেশের পর্যটন এলাকায় অধিকাংশ হোটেল, রিসোর্ট ফাঁকা; বরং বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে।
বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব), অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সিজ অব বাংলাদেশ (আটাব), প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ, টু৵রিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, কক্সবাজার হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস মালিক সমিতি, একাধিক ট্রাভেল এজেন্ট ও ট্যুরিস্ট পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।
মানুষের বেড়াতে যাওয়ার আগ্রহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পর্যটন খাতে খরচও বেড়েছে বলে মনে করছেন পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে উড়োজাহাজের টিকিটের দাম বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে টিকিটের দাম কয়েক গুণ হয়ে গেছে। তাই বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে; আর দেশের ভেতরে যাঁরা বেড়াতে যান, তাঁরা আসলে নিয়মিত খরচের চাপে খুব একটা স্বস্তিতে নেই।
টোয়াব সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী প্রথম আলোকে বলেন, ঈদুল ফিতরের তুলনায় সাধারণত ঈদুল আজহায় পর্যটকের চাপ কম থাকে। তবে আগের কোরবানির ঈদের তুলনায় এবার পর্যটকদের আগ্রহ আরও কম। অর্থনীতির খারাপ অবস্থা, গরম আবহাওয়া ও উড়োজাহাজের টিকিটের বাড়তি দামের কারণেই এটা হয়েছে বলে তাঁর ধারণা।
দেশের ১০৪টি পর্যটন এলাকাতেই নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে ট্যুরিস্ট পুলিশ। প্রতিটি জেলায় পুলিশ সুপার তাঁদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও পতেঙ্গায় ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসিয়ে ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারি করা হচ্ছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের সুগন্ধা, কলাতলী, লাবণী ও ইনানী সমুদ্রসৈকতে বিশেষ নিরাপত্তা রাখা হয়েছে।
টোয়াবের একাধিক সদস্য বলছেন, দেশে বেড়ানোর জনপ্রিয় গন্তব্য হচ্ছে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, কুয়াকাটা, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, সুন্দরবন ও সেন্ট মার্টিন। এর মধ্যে সুন্দরবন ও সেন্ট মার্টিনে এ সময় পর্যটন মূলত বন্ধ থাকে; কিন্তু এক বছরের বেশি সময় ধরে বিদেশি পর্যটকেরা অনুমতি পাচ্ছেন না পার্বত্য এলাকায় যাওয়ার। ৯ মাস ধরে বান্দরবানে বেড়ানোর ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
গরমের কারণে রাঙামাটিতেও চাপ কম পর্যটকের। মেঘ আর বৃষ্টি উপভোগ করতে সাজেকে যাচ্ছেন কেউ কেউ। তবে এবার জুনের অর্ধেক পার হওয়ার পরও তেমন বৃষ্টির দেখা নেই। তাই বৃষ্টি উপভোগ করতে যাওয়া পর্যটকদের গন্তব্য শ্রীমঙ্গল, সিলেট এলাকাতেও চাপ কম। তবে ঈদের পর বেশ কিছু বুকিং পেয়েছে শ্রীমঙ্গলের রিসোর্টগুলো। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন প্যাকেজ ছেড়েছে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো। হোটেল-রিসোর্টও দিয়েছে ছাড়।
তবে সবচেয়ে বেশি ছাড় দিয়েছে কক্সবাজারের হোটেল-রিসোর্ট। দেশের মধ্যে পর্যটনের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজার। সাড়ে পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট আছে এখানে। এসব হোটেলে দিনে ধারণক্ষমতা দুই লাখের বেশি। স্থানীয় হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতি বলছে, ঈদের পরদিন থেকে মূলত বুকিং শুরু হয়। গত বছরের তুলনায় এবার বুকিং অনেক কম। সেন্ট মার্টিন বন্ধ, মহেশখালী ও সোনাদিয়াতেও বেড়ানো যাচ্ছে না এখন—সমুদ্র উত্তাল, সঙ্গে প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া। এ কারণে এবার পর্যটকদের আগ্রহ কম।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রোববার পর্যন্ত ১০ থেকে ১২ শতাংশ অগ্রিম বুকিং নিশ্চিত হয়েছে। কোরবানির ঈদে এমনিতেই চাপ কম থাকে। এবার সব মিলিয়ে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার পর্যটক আসতে পারেন। ছাড় দিয়েও বুকিং মিলছে না।
প্রতিবছর ঈদের ছুটিতে তিন লাখ থেকে চার লাখ মানুষ দেশের বাইরে বেড়াতে যান। তবে এবার এটি আগের বছরের তুলনায় কমতে পারে। দেশের ভেতরে ঈদের পরদিন থেকে বেড়ানো শুরু হলেও বিদেশযাত্রা শুরু হয় ঈদের আগেই। দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য হচ্ছে ভারত। প্রতিবেশী দেশটিতে যেতে সড়কপথে ব্যাপক চাপ দেখা গেছে। কয়েক দিন ধরে বেনাপোল সীমান্তে হাজার হাজার পর্যটকের ভিড় দেখা গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে অভিবাসন বিভাগের লাইনে।
যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা দীপক কুমার রায় (৬৫) ক্যানসারে আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যান। কাগজপত্র যাচাই শেষে বেনাপোল-পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন পার হতেই তাঁর সাড়ে ছয় ঘণ্টা সময় লাগে।
বেনাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম বলেন, ঈদের ছুটি উপলক্ষে বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ২৪ হাজারের বেশি যাত্রী দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত করেছেন। স্বাভাবিক সময়ে এ সংখ্যা পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজারের মধ্যে থাকে। তবে এবার রেকর্ডসংখ্যক যাত্রী যাতায়াত করেছেন, যাঁদের অধিকাংশই ঈদভ্রমণ ও চিকিৎসার জন্য ভারতে গেছেন।
ভারতের পর জনপ্রিয় গন্তব্যের তালিকায় আছে নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যুক্ত হয়েছে মালদ্বীপ। এর বাইরে দুবাই ও ভিয়েতনামে এবার যাচ্ছেন কেউ কেউ। টোয়াব সদস্যরা বলছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তুরস্কের ভিসা কঠিন হয়েছে। ভুটান ভ্রমণ কর কমালেও উড়োজাহাজের ভাড়া বেশি হওয়ায় পর্যটকদের তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না দেশটিতে যেতে। নতুন গন্তব্য হিসেবে কেনিয়া, উজবেকিস্তান, জর্ডান, কিরগিজস্তানেও আগ্রহ আছে কারও কারও।
প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব তৌফিক রহমান প্রথম আলোকে বলেন, উড়োজাহাজের ভাড়া প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই বিদেশে যেতে আগ্রহ বাড়লেও অনেকে যেতে পারছেন না। কম খরচ ও সহজে ভিসা পাওয়া যায়, এমন দেশগুলোতেই আগ্রহ বেশি।