মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খানের প্রথম জানাজা ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ শনিবার সকাল ১০টায় এই জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজা শেষে তাঁর মরদেহ নোয়াখালীতে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়।
সিরাজুল আলম খান অমর হয়ে থাকবেন মন্তব্য করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘যাঁদের কথা আমাদের কখনোই ভুলে গেলে চলবে না, আজকে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁদের ভুলে যাওয়া হয়েছে। আজকে দেখেন, স্বাধীনযুদ্ধের সঙ্গে যাঁরাই জড়িত ছিলেন, অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের কেউই সেভাবে সামনে আসছেন না, তাঁদের সেই মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, সর্বাধিনায়ক ওসমানী (স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী), স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে কাউকেই সেই মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্যজনক।’
বায়তুল মোকাররমে সিরাজুল আলম খানের জানাজার আগে কথা বলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব। তিনি বলেন, ‘তাঁর ইচ্ছা, পরিবার, তাঁর গঠিত দল জেএসডির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আলোচনা করে আজকের সিদ্ধান্ত, যাতে কোনো বিতর্ক না হয়, জানাজা শেষ করে এখনই আমরা নোয়াখালীর উদ্দেশে যাত্রা করব। উনার বাড়ি বেগমগঞ্জ চৌরাস্তার বামপাশে। ওখানে মা ও বাবার কবরের পাশে উনাকে দাফন করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ নামে একটা দেশ হবে, এটা যখন কেউ চিন্তা করেননি তখন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য নিউক্লিয়াস গঠন করেছেন। সিরাজুল আলম খান নীরবে-নিভৃতে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করব।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এত বড় একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, এত বড় সংগঠক আরেকজন হয়তো নেই-ই, অথচ উনি বলেছেন, ‘আমাকে কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেবেন না এবং ওই সব জায়গায় নেবেন না’, যেমন শহীদ মিনারে নেওয়া গেল না। উনি এটা চাননি।’
সিরাজুল আলম খানের জানাজায় আরও অংশ নেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জনসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম প্রমুখ।
জানাজায় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির।
গতকাল শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।তিনি উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রমণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা শোক জানিয়েছেন। রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও অনুসারীদের অনেকে গতকাল তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে যান। রাজনীতিকদের অনেকে বলেছেন, সিরাজুল আলম খান জনসমক্ষে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতিও দিতেন না। তিনি আড়ালে থেকেই তৎপরতা চালাতেন। এখন তিনি নীরবে চলে গেলেন।
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘দাদাভাই’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক হন সিরাজুল আলম খান। ১৯৬৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হয় তাঁর উদ্যোগেই।
জানাজা শেষে সিরাজুল আলম খানের মরদেহে ফুল ও জাতীয় পতাকা দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। যেসব রাজনৈতিক দল, জোট ও সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে বিএনপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণতন্ত্র মঞ্চ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, জাগ্রত বাংলাদেশ ও জাতীয় শ্রমিক জোট বাংলাদেশ।
ষাটের দশকের প্রথমার্ধেই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে এর নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন সিরাজুল আলম খানসহ ওই ছাত্রনেতারা।
কিন্তু ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়। তখন ছাত্রলীগ ভেঙে ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাসদের প্রতিষ্ঠা হয়।
সিরাজুল আলম খান কখনো দলের নেতৃত্বে ও জনসমক্ষে আসতেন না। তিনি জাসদ নেতাদের আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন। সে জন্য তিনি জাসদ নেতাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ এবং রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান।
দীর্ঘদিন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। চিরকুমার সিরাজুল আলম খান কয়েক বছর ধরে ঢাকার কলাবাগানে ভাইদের সঙ্গে থাকতেন বলে তাঁর পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।
সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে লেখক মহিউদ্দিন আহমদের বই প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘সিরাজুল আলম খান তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা বলেছিলেন। সেটি হলো, ‘আমার মৃত্যুর পর কোনো শোকসভা হবে না। শহীদ মিনারে ডিসপ্লে হবে না লাশ। যত দ্রুত সম্ভব নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে মরদেহ, যা ঢাকা থাকবে একটা কাঠের কফিনে। মায়ের একটা শাড়ি রেখে দিয়েছি। কফিনটা শাড়িতে মুড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, মায়ের কবরে।’