মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)

জুন মাসে অন্তর্দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগের ৪ নেতা–কর্মী নিহত

দলীয় কোন্দল বা অন্তর্দ্বন্দ্বে চলতি জুনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চার নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। এ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতা হয় ২০টি। এর মধ্যে শাসক দলের মধ্যেই হয়েছে ১৯টি।

মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) জুন মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আজ রোববার এমএসএফ এ প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে।

এমএসএফ মূলত দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে ও নিজেদের অনুসন্ধান থেকে মানবাধিকার প্রতিবেদনটি তৈরি করে।

এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুন মাসে বিরোধীদলীয় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও বিএনপি তাদের নিজস্ব কর্মকাণ্ড ধরে রাখার লক্ষ্যে জনসংযোগ কর্মকাণ্ড করেছে। রাজনৈতিক মাঠে বিএনপি না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের বিষয়টি জনমনে ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। এ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ২০টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৮৯ জন। তাঁদের মধ্যে ৪ জন নিহত ও ১৮৫ জন আহত হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে ১৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন।

এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০টি ঘটনার মধ্যে ১৯টি ঘটনা ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে; আর একটি ঘটনা ঘটেছে বিরোধী দল বিএনপির। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজনই ক্ষমতাসীন দলের কর্মী যারা অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে মারা গেছেন। তাঁরা হলেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজে ছাত্রলীগ নেতা আলামিন হোসাইন (২০), রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, পাবনার সুজানগর উপজেলার আওয়ামী লীগ কর্মী মোজাহার বিশ্বাস (৫৪) ও নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সুরুজ মিয়া (৬৫) নামের আওয়ামী লীগ নেতা।

এমএসএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন দলের আরও চার নেতা–কর্মী এ মাসেই খুন হয়েছেন, যার পেছনে রাজনৈতিক যুক্ততার বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। খুন হওয়া চারজনের মধ্যে আছেন কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলায় যুবলীগ নেতা তানভীর আহমেদ ভূঁইয়া (৩২), মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাব খান, পাবনায় জহিরুল ইসলাম বাবু ওরফে ঢাক বাবু (৪৫) এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে জেলা পরিষদের সদস্য ও নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম।

নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহত

এ মাসে দেশের শেষ ধাপে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভাসহ স্থগিত নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়।

এমএসএফ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, একপক্ষীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, পাশাপাশি জনজীবনকে আতঙ্কের মধ্যে রেখে সরকার নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতায় হতাহতের সংখ্যা উদ্বেগজনক। তবে সরকারি প্রশাসনের মাধ্যমে সংঘাত এড়ানো ও ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টায় ছিলেন প্রার্থীরা। নির্বাচনে বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নেওয়ায় নির্বাচনটি যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তেমনি ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনী সহিংসতার ৪৭টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪৯৪ জন। এর মধ্যে ৭ জন নিহত ও ৪৮৭ জন আহত হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, পিরোজপুর, পাবনায় একজন করে ও যশোরে দুজন ব্যক্তি নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন কিশোর রয়েছে।

সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের লঙ্ঘন

জুন মাসে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র উদ্বেগজনক বলে এমএসএফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এ মাসের ১৬টি ঘটনায় ২৩ জন সাংবাদিক দেশের বিভিন্ন জেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আহত ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন ৮ জন, হুমকির সম্মুখীন ২ জন, লাঞ্ছিত হয়েছেন ৪ জন এবং সংবাদ প্রকাশের জেরে ৩টি মামলা হয়েছে ৯ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। যার মধ্যে একটি মামলা চলতি বছরের এপ্রিল মাসে হয়েছে অবৈধ বালু উত্তোলনের খবরের জেরে, যা এ মাসে পত্রিকায় প্রকাশ পায়। এ ছাড়া দুজন সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ করার সময় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আহত হন।

এ মাসের ১৬টি ঘটনার ৩টি ক্ষমতাসীন দল, ২টি পুলিশ, ১টি সরকারি কর্মকর্তা, ১টি পৌরসভার কর্মকর্তা, ১টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ১টি বালু উত্তোলনকারী, ৩টি মাদক ব্যবসায়ী, ২টি অপরাধী দল ও ২টি ঘটনায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের সংশ্লিষ্টতা ছিল।

এমএসএফ মনে করে, যেভাবে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয় বরং এভাবে বাধা সৃষ্টি করে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার ও বাক্‌স্বাধীনতাকে সংকুচিত করা হচ্ছে।

সাইবার নিরাপত্তা আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার

এমএসএফ বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার ও অপব্যবহার যেভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে জনমনে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করা হয়েছিল, সাইবার নিরাপত্তা আইনও একইভাবে সাইবার মাধ্যম ব্যবহারকারীর জন্য হয়রানি, হুমকি, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতাবোধ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। তথ্য নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করে ভিন্নমত দমন ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের হাতিয়ার হিসেবে সাইবার নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে।

এ মাসে সাইবার নিরাপত্তা আইনে ৯টি মামলায় অভিযুক্ত ২০ জন ব্যক্তির মধ্যে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন হিন্দুধর্মাবলম্বী যুবক। যাঁদেরকে ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া, এক এনজিও কর্মীকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তি, এক যুবককে ফেসবুকে অশ্লীল ছবি পোস্ট করার এবং দুজন যুবককে দিনাজপুরে এসপির নামে ফেসবুক আইডি খুলে প্রতারণা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পাশাপাশি আটটি মামলার মধ্যে দুটি মামলা হয়েছে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যঙ্গাত্মক ছবি প্রকাশ, মানহানি ও কটূক্তি করার অভিযোগে, চারটি মামলা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া, একটি মামলা হয়েছে হ্যাকিং–সংক্রান্ত, একটি মামলা হয়েছে ফেসবুকে অশ্লীল ছবি পোস্ট করার ও একটি মামলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তি করার অভিযোগে।