সাড়ে ১০ বছর বয়সী ফারহান ইশরাকের (রিহান) শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। ফারহান তার বাবা এ কে এম ওহিদুল হকের কাছে বারবার জানতে চাইত, ‘বাবা আমার কিছু হবে না তো?’ ‘তোমার কিছু হবে না’-বাবার এই আশ্বাসবাণী কাজে লাগেনি। ১ সেপ্টেম্বর ফারহান মারা গেছে।
ফারহানের রক্তের পরীক্ষায় ডেঙ্গু নেগেটিভ থাকলেও জ্বর ও অন্যান্য শারীরিক জটিলতা ছিল। প্লাটিলেটও কমেছিল। বিশেষজ্ঞ যে চিকিৎসক দেখেছিলেন, তিনি ফারহানের ডেঙ্গু নেগেটিভ দেখে বলেছিলেন ভয়ের কিছু নেই।
ফারহানের মা ও বাবা এখন ভাবছেন, চিকিৎসক ছেলের জন্য আইজিএম, আইজিজি, আরটিপিসিআরসহ অন্য যেসব পরীক্ষা আছে, সেসব যদি করতে বলতেন, তাহলে হয়তো নিশ্চিত হওয়া যেত, ছেলের আসলে কী হয়েছে। ছেলের জ্বর না কমায় সংক্রমণ থাকতে পারে, এটা বলে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিকও শুরু করেছিলেন। এটাও ঠিক হলো কি না, তা-ও ভাবছেন এই বাবা ও মা। ফারহানের ২৫ আগস্ট থেকে জ্বর আসার পর ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ওই চিকিৎসকের চেম্বারে নেওয়া হয়েছে কয়েকবার।
ফারহানকে যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চিকিৎসা দিয়েছিলেন, চেম্বারে ফোন নম্বরে ফোন দিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাই তাঁর নামটা প্রকাশ করা হলো না।
ফারহান ধানমন্ডির স্কলার্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি গিটার বাজাতে পছন্দ করত। বিশ্ব, ইতিহাস নিয়ে জানার আগ্রহ ছিল বেশি। নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে কেন পরাজিত হলেন, এসব নিয়ে সে বাবার সঙ্গে আলোচনা করত। মা-বাবার আক্ষেপ, ‘পৃথিবী নিয়ে এত আগ্রহ থাকা ছেলেটা পৃথিবীতেই থাকতে পারল না।’
ব্যাংকার এ কে এম ওহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলেটা একটু ভিতু ছিল। নিজেই মশার কামড় থেকে বাঁচতে ওডোমস মাখত। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে শুধু জানতে চাইত, বাবা, আমার কিছু হবে না তো? মাথা থেকে ছেলের এই কথা কিছুতেই সরাতে পারছি না। ছেলের জন্য কিছু করতে পারলাম না।’
গত রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় গিয়ে দেখা গেল, ফারহানের ঘরের বিছানাটি ফাঁকা পড়ে আছে। বিছানার চাদরে অসংখ্য ছোট ছোট গাড়ির ছবি। ঘরের পর্দাও নিজের পছন্দে কিনেছিল। গত ২৪ আগস্ট শেষবারের মতো স্কুলে গিয়েছিল, মাঠে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিল। বসার ঘরে ঝুড়িভর্তি ছোট ছোট খেলনা গাড়িসহ অন্যান্য জিনিস পড়ে আছে। বিভিন্ন দেশের কয়েন, পয়সা জমানোর নেশা ছিল ফারহানের। ফারহানের বাবা ও মা তাবাসসুম তাহরীন যেখানেই হাত দিচ্ছেন সেখানেই ছেলের কোনো না কোনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।
মা-বাবা কেমনে সন্তানের মৃত্যু সহ্য করছেন, তা ভাবতাম
তাবাসসুম তাহরীন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। ছেলে ফারহান এবং সাড়ে চার বছর বয়সী মেয়ে আমিরা হককে একটু বেশি সময় দেওয়ার জন্য নিজের ক্যারিয়ারের কথা সেভাবে ভাবেননি। শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছেন।
এই মা ছেলের স্কুলের ইস্তিরি করা নতুন পোশাক বের করে দেখালেন। জানালেন, ছেলে পোশাকটি ৭ সেপ্টেম্বর পরীক্ষার দিন পরতে চেয়েছিল। এখন তো ছেলেই নেই। ২০২১ সালেও ফারহানের ডেঙ্গু হয়েছিল। সেবার হাসপাতাল ভর্তির পর হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছিল।
তাবাসসুম তাহরীন বলেন, ‘এত দিন ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া শিশুদের মা-বাবা কেমনে সন্তানের মৃত্যু সহ্য করছেন, তা ভাবতাম। এখন নিজেরাই তা সহ্য করছি। সন্তানের এমন মৃত্যুর জন্য সারা জীবন বিলাপ করতে হবে। ছোট বোনকে ছেলেটা খুব ভালোবাসত। নিজের পড়ার টেবিলের কাচের নিচে বোনের ছবি রেখে দিয়েছিল। আমি স্কুলে থাকলে ফোন করে বলত-বুড়ির ডায়াপার পাল্টাবে কি না, একটু দুধ খাইয়ে দেবে কি না। অথচ এই বোনটার ভাইকে নিয়ে কোনো স্মৃতিই মনে থাকবে না। মা-বাবা সারাক্ষণ কাঁদছেন, এটা দেখে দেখে মেয়েটা বড় হবে। ওর সুন্দর শৈশব বলতে আর কিছু থাকল না।’
ছোট্ট আমিরা বাসার পরিবেশ দেখে বুঝতে পারছে, বড় কোনো ঘটনা ঘটেছে। চোখের সামনে তার ভাইকে দেখছে না। মায়ের কাছে জানতে চায় ভাই খেলতে গিয়েছে কি না। বড়রা কান্নাকাটি করে তার ভাইকে নিয়ে আলোচনা করলে রেগে যাচ্ছে। বাসার গৃহকর্মীসহ অন্যদের মারছে, যা সে আগে কখনো করত না। তাই মেয়ে কোনো ট্রমার মধ্যে চলে যায় কি না, তা নিয়েও ভাবছেন মা-বাবা।
গত ৩১ আগস্ট রাত আটটায় ফারহান স্কুলের অভিভাবকদের জুম মিটিংয়ে নিজে থেকেই শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। রাত সাড়ে ১১টায় বুকে ব্যথার কথা জানায়। এ কে এম ওহিদুল হক বলেন, ছেলে সবকিছু নিয়েই একটি প্যানিক করত বা ভয়ে বাড়িয়ে বলত। তাই প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন বুকে ব্যথার কথাও হয়তো এমনি বলছে। তারপরও রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফারহানকে গ্রিন রোডের বেসরকারি একটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে স্যালাইন দেওয়া হয়। জানতে চাওয়া হয়, ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করতে চান কি না। তখন ওহিদুল হক বলেছিলেন, যদি ভর্তি করা প্রয়োজন হয়, তাহলে অবশ্যই ভর্তি করবেন। তবে জরুরি বিভাগ থেকে ভর্তির বিষয়ে আর কিছু না বলায় ফারহানকে বাসায় আনা হয়।
তবে স্যালাইন দেওয়ার পর থেকে ফারহান ঘামতে থাকে। কাশি শুরু হলে নেবুলাইজার করা হয়। কিন্তু ছেলে বিছানায় পায়খানা করে দেয়, নিজেই বলে তা পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য। পরিষ্কার করে বিছানায় নিতে নিতে ছেলের মুখে ফেনা আসে। শরীর নীল হয়ে যায়। তারপর ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়ানো। শ্যামলীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে যখন নেওয়া হয়, তখন চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান, ফারহান মারা গেছে।
ওহিদুল হক বলেন, ‘ছেলে মারা যাওয়ার পর ওই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে ছেলে মারা গেছে জানিয়ে ওই তাঁকে বলেছি, তাঁর ব্যবস্থাপত্রে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, তা আবার পর্যালোচনা করতে। আমরা নিজেরাও এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। একই সঙ্গে আর কোনো মা-বাবার বুক যাতে খালি না হয়, তাই চিকিৎসককে বিষয়টি জানিয়েছি।’
ফারহানের মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিতে বাসায় আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা এসেছে। প্রথম আলোর কাছে একেকজন দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। একই সঙ্গে সন্তানের ডেঙ্গু হলে মা-বাবা এবং চিকিৎসকেরা যাতে আর একটু সচেতন হন, সেই আহ্বানও জানান।
প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ফারহানের মা তাবাসসুম তাহরীন আতঙ্কিত হয়ে মশার কয়েল ধরাতে বললেন একজনকে। এই মা বলেন, ‘আমার স্কুল থেকে ফেরার সময় হলে ছেলে ফোন দিয়ে জানতে চাইত আর কতক্ষণ লাগবে? ছেলে দরজা খুলে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত। এখন আর আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকবে না। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না, আমার ছেলেটা মারা গেছে। ছেলেটা লম্বা চওড়া ছিল, বুকে নিলে আমার বুকটা ভরে থাকত। এখন তো আমার বুকটা খালি হয়ে গেল। শুধু যদি নিশ্চিত হতে পারতাম, ছেলের ডেঙ্গু হয়েছে, তাহলে ছেলেকে ঘরে নিয়ে বসে থাকতাম না। হাসপাতালে ভর্তি করতাম। কেন ছেলেটা মারা গেল, তা-ই তো জানতে পারলাম না।’