ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

ময়নাতদন্ত ছাড়াই অনেকের দাফন, বিচার নিয়ে শঙ্কা

ঢাকা মেডিকেল থেকে ময়নাতদন্ত ছাড়া ৬০টি লাশ নিয়ে যান স্বজনেরা। একইভাবে সোহরাওয়ার্দী থেকে নেওয়া হয় ৪১টি লাশ।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ-সংঘাতে এখন পর্যন্ত ৫৮০ জনের নিহত হওয়ার খবর জানা গেছে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়েছিল ২০৮ জনকে। তাঁদের অনেককে আনা হয় মৃত অবস্থায়, আবার অনেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

প্রথম আলোর অনুসন্ধান অনুযায়ী, ঢাকা মেডিকেলে ময়নাতদন্ত হয়েছে ১০৭ জনের। আর ময়নাতদন্ত না করে ৬০টি লাশ স্বজনেরা নিয়ে গেছেন। একইভাবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ৪১ জনের লাশ ময়নাতদন্ত না করে স্বজনেরা নিয়ে যান। এর বাইরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া অনেকের লাশ হাসপাতালে আনা হয়নি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে লাশ নিয়ে দাফন করেছেন স্বজনেরা। প্রথম আলো ১০৭ জনের হিসাব পেলেও ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ দাফনের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ফৌজদারি আইনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না থাকলে এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না। ফৌজদারি কার্যবিধি ও পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী, অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার কোনো ব্যক্তির লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই। আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হচ্ছে ফৌজদারি মামলার তদন্ত ও বিচারের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান।

১০১টি লাশের ময়নাতদন্ত হয়নি

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গুলিবিদ্ধ বা অন্যভাবে মারাত্মক জখম নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন ১৬৭ জন। তাঁদের অনেককে আনা হয় মৃত অবস্থায়, আবার অনেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর মধ্যে ১০৭ জনের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত হয়েছে। অন্যগুলোর ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল ছাড়া লাশ নিয়ে যান স্বজনেরা। বাকি ৬০ জনের ময়নাতদন্ত হয়নি।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন ৪১ জন। পরে তাঁদের মৃত ঘোষণা করা হয়। তাঁদের কারও মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়নি। এ ছাড়া পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ লাশ এসেছিল চারটি। ময়নাতদন্ত হয়েছে মাত্র দুটির।

লাশ হস্তান্তরের বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সংঘাত-সংঘর্ষে নিহতদের কোনো কোনো স্বজন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়াই জোর করে হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে গেছেন। এসব মৃত্যুর খবর পুলিশকে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হয়েছিল। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, ময়নাতদন্ত ছাড়া কোনো মরদেহ নিয়ে যাওয়ার কোনো তথ্য তিনি জানেন না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কাজী গোলাম মোখলেসুর রহমান জানান, তাঁর বিভাগে ১০৭ জনের ময়নাতদন্ত হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ-সংঘাতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জুলাই ও আগস্টে মারা যান ৪১ জন। এসব লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশকে জানানো হলেও তারা আসেনি। ফলে বাধ্য হয়ে লাশগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এই হাসপাতালের পরিচালক শফিউর রহমান।

আইনজ্ঞরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি পুলিশের প্রবিধান অনুযায়ী, কোনো থানা এলাকায় কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ামাত্র পুলিশ লাশ দেখতে যাবেন। এরপর মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করবেন। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে মরদেহ পাঠাতে হবে ফরেনসিক চিকিৎসকের কাছে। ফরেনসিক চিকিৎসক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবেন। সেই প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ লিপিবদ্ধ করবেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন খুনের মামলার অন্যতম সাক্ষ্য।

আইন কী বলে

অস্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া ব্যক্তির সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরির বিষয়ে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের কী করণীয়, সে ব্যাপারে ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১৭৪ ধারা ও পুলিশের প্রবিধানের (পিআরবি) ২৯৯ ধারায় বর্ণিত হয়েছে।

সিআরপিসির ১৭৪ ধারায় বলা হয়েছে, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যদি সংবাদ পান, কেউ আত্মহত্যা করেছেন বা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বা যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে, অপর কোনো ব্যক্তি অপরাধে জড়িত, তখন পুলিশ সেই ব্যক্তির সুরতহাল তৈরি করবেন। পরে মরদেহের ময়নাতদন্তের জন্য ফরেনসিক চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন। পিআরবির ২৯৯ ধারা অনুযায়ী, অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে পুলিশ ৪৮ নম্বর ফরমে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করবেন। মৃত ব্যক্তির লাশ যেখানে আছে, সেখানে যাবেন পুলিশ পরিদর্শক বা সহকারী পরিদর্শক বা হেড কনস্টেবল। তদন্ত শেষে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রতিবেদন দেবেন। প্রত্যেক অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে কেস ডায়েরি তৈরি করে তা সংরক্ষণ করতে হবে।

গুলিবিদ্ধ মৃতদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া লাশ হস্তান্তর করা আইনসিদ্ধ নয় বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ। ৭ আগস্ট তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত ও সংঘর্ষে ছাত্র, জনতা ও পুলিশের যেসব সদস্য মারা গেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন করা উচিত ছিল। কারণ, কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করতে হবে। ময়নাতদন্ত না হলে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ জানা যাবে না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি লঙ্ঘনের দায়ে জড়িত সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব খুনের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হলে প্রতিটি মরদেহের ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।