নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে আদালতে ন্যায়বিচার চাইলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ড. মুহাম্মদ ইউনূস
ফাইল ছবি

শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে করা মামলায় নিজেকে আদালতের কাছে নিরপরাধ দাবি করেছেন গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

রাজধানীর পল্টনে অবস্থিত ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে আজ বৃহস্পতিবার তিনি হাজির হয়ে লিখিতভাবে নিজেকে নিরপরাধ দাবি করেন। পাশাপাশি মামলার অপর তিন আসামিও নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। আদালত ১৬ নভেম্বর যুক্তিতর্ক শুনানির দিন ঠিক করেছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, আজ আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিবাদীরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে লিখিত বক্তব্য জমা দিয়েছেন। নিজেদের নিরপরাধ দাবি করে তাঁরা ন্যায়বিচার চেয়েছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিবাদীরা লিখিত বক্তব্যে বলেন, গ্রামীণ টেলিকম যেসব ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করেন, সেগুলো চুক্তিভিত্তিক। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে তা নবায়নের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। গ্রামীণ টেলিকমের প্রকল্প নোকিয়া কেয়ার ও পল্লীফোনের কার্যক্রম তিন বছরের চুক্তি অনুযায়ী পরিচালিত হয়। মেয়াদ শেষে তা নবায়ন হয়। যেহেতু গ্রামীণ টেলিকমের কার্যক্রম চুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত, সে জন্য গ্রামীণ টেলিকমের সব কর্মকর্তা–কর্মচারীর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

অসৎ উদ্দেশ্যে মিথ্যা অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান মামলাটি করেছেন বলে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়।

আত্মপক্ষ সমর্থন করে বিবাদীরা আদালতকে বলেন, শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালা থাকতে পারে। তবে শ্রম আইনে যেসব সুবিধা দেওয়া আছে, তা থেকে কম হতে পারে না। গ্রামীণ টেলিকমে অর্জিত ছুটি–সংক্রান্ত নীতিমালা ২০০২ তৈরি করা হয়, যা ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর। শ্রম আইনের ১১৭(৭) ধারা অনুযায়ী, কোনো শ্রমিক অর্জিত ছুটির আবেদন করলে মালিক কোনো কারণে নামঞ্জুর করেন, তাহলে নামঞ্জুর করা ছুটি–সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের মূল ছুটির সঙ্গে অতিরিক্ত পাওনা হিসেবে যুক্ত হবে।  শ্রম আইন অনুযায়ী বিষয়টি প্রতিকার সম্ভব। এটা কোনোভাবে ফৌজদারি অপরাধ নয়। এ আইনের ব্যত্যয় ঘটলে সেটি প্রশাসনিক ও দেওয়ানি মামলার বিষয়।

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এর লভ্যাংশ বিতরণযোগ্য নয়। ফলে মূল লভ্যাংশের ৫ শতাংশ অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারী ইউনিয়ন ওই অর্থ পাওয়ার আশায় শ্রম আদালতে মামলা করে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে জানানো হয়, বিষয়টি নিয়ে মামলা চলমান। আদালত যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মামলার শুনানি শেষে এক প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি যেসব উদ্যোগ নিয়েছি, কোনোটিতে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য নিইনি। সেটা ব্যাংক হোক, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান হোক। মানুষ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করে লাভ করবে, মুনাফা করবে, বড় করবে। আমরাও লাভ করেছি, বড় করেছি। কিন্তু আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিক ব্যবসা। ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের উপকার। যিনি বিনিয়োগ করছেন, তিনি কোনো মুনাফা নেবেন না। আমি সামাজিক ব্যবসা বিষয়ের প্রবক্তা। বিশ্বব্যাপী এটাকে প্রচার করার চেষ্টা করছি। আমি নিজে যদি এর উল্টোটা করি, তাহলে তো আর হলো না।’

ব্যক্তিগত মুনাফা করার কোনো উদ্দেশ্য নেই দাবি করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্যে, আদর্শে, কোথাও ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়া, মালিক হওয়ার বিষয় নেই। আমি মালিকমুক্ত থাকব। আমি সেটাই ফলো করে যাচ্ছি। যেখানে আমি মালিকমুক্ত হতে চাই, সেখানে আমাকে একজনের কাছ থেকে কেড়ে আনতে হবে কেন?  এর কোনো কারণ নেই তো।’

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে এই মামলা করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।

মামলায় অপর তিন বিবাদী হলেন গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুর জাহান বেগম ও শাহজাহান।

মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনে যান। সেখানে গিয়ে তাঁরা শ্রম আইনের লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে পারেন। এর মধ্যে ১০১ শ্রমিক-কর্মচারীকে স্থায়ী করার কথা থাকলেও তাঁদের স্থায়ী করা হয়নি। শ্রমিকদের অংশগ্রহণের তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি।

আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, মাত্র ১১ কার্যদিবসে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। মামলায় চারজন সাক্ষ্য দেন।

এদিকে গত ৩০ মে ড. ইউনূসকে প্রধান আসামি করে আরও ১২ জনের নামে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

গত ৫ অক্টোবর দুদকে যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কোনো অপরাধ করিনি। তাই আমি শঙ্কিত নই।’