উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেছেন, তাঁর সরকার সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে প্রথম ধাপে ১৮ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকের মালয়েশিয়ায় যাওয়ার বিষয়ে অবিলম্বে মনোযোগ দেবে।
গতকাল শুক্রবার ঢাকার একটি হোটেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। ওই হোটেলে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে ঢাকার
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংক্ষিপ্ত একান্ত বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, ‘আমরা পুরো ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। আমাদের শ্রমিক দরকার, তাদের আধুনিক দাস হিসেবে গণ্য করা যাবে না। তারা বাংলাদেশ বা অন্য যেখান থেকেই আসুক না কেন, আমি এখানকার মতো আগেও প্রকাশ্যে এ কথা বলেছি।’
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বাংলাদেশকে সতর্কতা অবলম্বন করতে এবং মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি বা বিদেশি কারও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস শ্রমিক ইস্যুতে এই ঘোষণা দেওয়ার জন্য দেশের সব মানুষের পক্ষ থেকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
আনুমানিক আট লাখ বাংলাদেশি এখন মালয়েশিয়ায় কাজ করেন। এর মধ্যে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে মাসের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার লাখ অভিবাসী হয়েছেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তিনি তাঁর পুরোনো বন্ধুকে ঢাকায় স্বাগত জানাতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত। কারণ, তাঁরা চার দশকের বেশি সময় ধরে একে অপরকে চেনেন।
অধ্যাপক ইউনূস ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন বিপ্লব, ছাত্র ও জনগণের আত্মত্যাগ এবং পূর্ববর্তী সরকারের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন।
অধ্যাপক ইউনূস ও আনোয়ার ইব্রাহিম তাঁদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকস্থলে যাওয়ার জন্য একই গাড়িতে ওঠেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তাঁরা রাজনৈতিক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ—এই তিন মূল ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে আসিয়ানে বাংলাদেশের ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার’ হওয়ার বিষয়টিও বিশেষভাবে উত্থাপন করা হয়।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ‘কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’-এর ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার কোম্পানি ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর সমস্যা দ্রুত সমাধান করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, দুর্নীতি, সুশাসন ও অর্থনৈতিক মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে তারা আপস করে না।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যত দ্রুত সম্ভব যৌথ কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকটের আন্তর্জাতিক সমাধান চান ড. ইউনূস
যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত ও আন্তর্জাতিক সমাধানের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এই সমস্যার সমাধান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে, বাংলাদেশের একার হাতে নয়।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা বিষয়টি উত্থাপন অব্যাহত রাখব। মালয়েশিয়া আমাদের এ কাজে সহযোগিতা করবে। আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। এটি এমন একটি বিষয়, যা আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান করতে হবে।’
ড. ইউনূস বলেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কারণ, এটি মালয়েশিয়ার জন্যও একটি সমস্যা, সেখানেও স্বল্পসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। আমরা আসিয়ান, মালয়েশিয়া সরকার এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে একসঙ্গে কাজ করি।’
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আসিয়ানের পরবর্তী সভাপতি হতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া।
অধ্যাপক ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটের দুটি দিক তুলে ধরেন। ৭ বছর ধরে ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রতিবছর গড়ে জন্ম নেওয়া ৩২ হাজার নতুন শিশু।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, জন্মহার নিয়ে বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন নয়, তাদের জীবনে কী ঘটছে, সেটাই আসল ব্যাপার। তিনি বলেন, তরুণদের একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। এটা ক্ষুব্ধ তরুণদের একটি প্রজন্ম। তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, পুরো বিশ্বের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো এটি একটি টিকিং টাইম-বম্ব, যা যেকোনো উপায়ে বিস্ফোরিত হতে পারে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, মালয়েশিয়া এই সমস্যার আন্তর্জাতিক সমাধানের জন্য আসিয়ান ও আন্তর্জাতিক ফোরামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে।
লালগালিচা সংবর্ধনা
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সংক্ষিপ্ত সফরে শুক্রবার ঢাকায় আসেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।
গতকাল বেলা ২টায় ৫৮ সদস্যের প্রতিনিধিদল নিয়ে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তাঁকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় গান স্যালুট ও গার্ড অব অনারের মাধ্যমে তাঁকে সম্মান জানানো হয়।
বিমানবন্দরে এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
প্রায় এক দশক পর মালয়েশিয়ার কোনো প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করলেন। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর এটিই বাংলাদেশে কোনো সরকারপ্রধানের প্রথম সফর।
বিমানবন্দর থেকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে বাংলাদেশে সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে গতকাল সন্ধ্যায় কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বাসসকে জানান, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকা ত্যাগ করেন।