সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি

পুলিশের পিটুনি, বিএনপিপন্থীদের বের করে দিয়ে ভোট গ্রহণ

দায়িত্ব পালনের সময় এক সাংবাদিককে পেটাচ্ছে পুলিশ। গতকাল দুপুর পৌনে ১২টায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

উত্তেজনা ছিল মঙ্গলবার রাত থেকেই। গতকাল বুধবার দিনের শুরুতেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে কথা–কাটাকাটি, ধাক্কাধাক্কি হয়। নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত কোন উপকমিটির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এবারের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে, এমন প্রশ্নে তর্কে জড়ান তাঁরা।

এর কিছুক্ষণ পরই পুলিশ গিয়ে আইনজীবী, সাংবাদিকদের পিটিয়ে মিলনায়তন থেকে বের করে দেয়। পুলিশের হামলায় আইনজীবী, সাংবাদিকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন। গতকাল আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের (২০২৩-২৪) প্রথম দিনে ঘটেছে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা। ধাক্কাধাক্কি, মারধর, ভাঙচুর ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা পরে ভোট শুরু হয়। এমন অবস্থায় গ্রহণযোগ্য কমিটি করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।

আইনজীবী জেড আই খান পান্না গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, পুলিশ যেভাবে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে, তা ন্যক্কারজনক।

এদিকে আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ব্যালট পেপার চুরি ও ছিঁড়ে ফেলা এবং নির্বাচনসংক্রান্ত আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বাইরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগে গতকাল সন্ধ্যায় শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মো. মনিরুজ্জামান। মামলায় বিএনপিপন্থী আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন, রুহুল কুদ্দুসসহ ১২ জন আইনজীবীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির সদস্য আসাদুজ্জামান মনির প্রথম আলোকে বলেন, প্রার্থীসহ বিএনপিপন্থীদের আপত্তির কারণে সকাল ১০টায় ভোট গ্রহণ শুরু করা যায়নি। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর ১২টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে বিরতিহীনভাবে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলে। সমিতি প্রাঙ্গণে বিএনপিপন্থীরাই ভোটের প্যান্ডেল ভেঙেছে। এবারের নির্বাচনে ৮ হাজার ৬০২ জন ভোটারের মধ্যে প্রথম দিন ২ হাজার ২১৭ ভোট পড়েছে।

সভাপতি এক, সহসভাপতি দুটি, সম্পাদক একটি, কোষাধ্যক্ষ একটি, সহসম্পাদক দুটি, সদস্য সাতটি পদসহ মোট ১৪টি পদে এক বছর মেয়াদের জন্য সমিতির নির্বাচন হয়ে থাকে। বর্তমানে সমিতির সভাপতি, সম্পাদকসহ সাতটি পদে আছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা। অপর সাতটি পদে আছেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা।

নির্বাচনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল হলো বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সমর্থিত প্যানেল ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল।

গতকাল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পর এবার সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীদের নির্বাচনেও ভোট চুরি হচ্ছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি ভোট চুরির মহারাজা। সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনে জিততে তারা ব্যালট পেপার ছিনতাই করতে গেছে। নির্বাচন পণ্ড করতে হামলা করেছে।

ঘটনার শুরু
তফসিল অনুসারে, সমিতির দুই দিনব্যাপী নির্বাচনের আজ দ্বিতীয় দিন। ভোটের এক দিন আগে সোমবার নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরী ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। দুই পক্ষই ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাঁকে আহ্বায়ক হিসেবে মেনে নিয়েছিল। এর আগে মনসুরুল হক চৌধুরী সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেল থেকে সভাপতি পদে নির্বাচন করে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
আইনজীবী জেড আই খান পান্না প্রথম আলোকে বলেন, মনসুরুল হক চৌধুরী একজন দায়িত্ববান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। গুরুতর কোনো ঘটনা না ঘটলে তাঁর পদত্যাগ করার কথা নয়। নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে এমন কিছু হয়েছে, যে কারণে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।

মনসুরুল হক পদত্যাগ করলে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা নির্বাচন পরিচালনার উপকমিটির আহ্বায়ক হিসেবে মো. মনিরুজ্জামানকে মনোনীত করেন। এরপর পরই সেদিন বিএনপি–সমর্থিত আইনজীবীরা এ এস এম মোকতার কবির খানকে আহ্বায়ক মনোনীত করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, আওয়ামী লীগ মনোনীত আহ্বায়ক নির্বাচনের কার্যক্রম শুরুর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার রাতে ব্যালট পেপারে সই করতে সমিতির তিনতলার সম্মেলনকক্ষে যান। এতে আপত্তি জানান বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। এ নিয়ে হইচই, হট্টগোল শুরু হয়। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া এবং হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়।

এর আগে সমিতির গত নির্বাচনে (২০২২-২০২৩) ভোট শেষে গণনাপর্যায়ে সম্পাদক পদে পুনরায় ভোট গণনাকে ঘিরে নির্বাচন উপকমিটির আহ্বায়ক এ ওয়াই মসিউজ্জামান পদত্যাগ করেন। এর এক মাসের বেশি সময় পর ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হয়।

হট্টগোল, ধাক্কাধাক্কি ও মারধর

সমিতির নির্বাচন ঘিরে গতকাল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবন এবং প্রাঙ্গণে বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়। সমিতি প্রাঙ্গণে গতকাল সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ–সমর্থিত আইনজীবীদের উপস্থিতি ছিল। ১০টার দিকে সমিতির মিলনায়তনে নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য এবং দুই পক্ষের প্রার্থীদের দেখা যায়।

১০টার দিকে বিএনপি-সমর্থিত প্যানেল থেকে মনোনীত সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুসের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির একজন সদস্যের কথা-কাটাকাটি চলছিল। অন্যদিকে উপকমিটির পক্ষ থেকে বারবার প্রার্থীদের নির্ধারিত জায়গায় যেতে বলা হচ্ছিল। এ সময় আওয়ামী লীগ–সমর্থিত আইনজীবীরা ‘ইয়েস, ইয়েস’ বলে স্লোগান দেন। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত এক আইনজীবীর সঙ্গে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের ধাক্কাধাক্কি হয়। পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন সমিতির সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির। তিনি আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্যানেল থেকে এবারের নির্বাচনে সভাপতি পদপ্রার্থী।

পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থানের প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে সমিতির মিলনায়তনে শতাধিক পুলিশ প্রবেশ করে বলে একাধিক আইনজীবী ও প্রত্যক্ষদর্শী জানান। তাঁদের তথ্যমতে, বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও সাংবাদিকদের মিলনায়তনের ভেতর থেকে বের করে দেয় তারা। এ সময় পুলিশের মারধরে আইনজীবী, সাংবাদিকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন। এরপর দুপুর ১২টার দিকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। সমিতির বর্তমান সভাপতি, সম্পাদকসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন অংশের মনোনীত উপকমিটির আহ্বায়ক মো. মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে ভোট গ্রহণ চলে।

আহত সাংবাদিকদের মধ্যে এটিএন নিউজের সাংবাদিক জাবেদ আখতার রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হামলার শিকার অন্যরা হলেন প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক শুভ্র কান্তি দাশ, জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ফজলুল হক মৃধা, আজকের পত্রিকার এস এম নূর মোহাম্মদ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের জান্নাতুল ফেরদাউস, বৈশাখী টেলিভিশনের ক্যামেরা পারসন ইব্রাহিম হোসেন, এটিএন বাংলার ক্যামেরা পারসন হুমায়ুন কবির ও মানবজমিন–এর আবদুল্লাহ আল মারুফ।

বিকেলে উত্তাপ, ভাঙচুর, পাল্টা ধাওয়া

এদিকে বেলা তিনটার দিকে সমিতির অ্যানেক্স ভবনের সামনে প্রেস ব্রিফিং করেন বিএনপি–সমর্থিত প্যানেল থেকে সভাপতি প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন ও সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুস। এ সময় শতাধিক বিএনপিপন্থী আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে আড়াইটার দিকে তাঁরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে ঘটনার বর্ণনা করেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

প্রেস ব্রিফিং শেষে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা সমিতি প্রাঙ্গণে নির্বাচনী প্যান্ডেলের দিকে মিছিল নিয়ে আসেন। সেখানে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত আইনজীবীদের কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। সাড়ে তিনটার দিকে একদল আইনজীবী প্যান্ডেল ভাঙচুর করেন। একপর্যায়ে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা সমিতি ভবনের মিলনায়তনের দিকে চলে যান। এরপর পরই আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা স্লোগানসহ পাল্টা মিছিল করেন। এ সময় সমিতি ভবন ও প্রাঙ্গণে বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়।

গ্রহণযোগ্য কমিটি করে নতুন নির্বাচন দাবি

প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপি–সমর্থিত প্যানেল থেকে সভাপতি প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন অভিযোগ করে বলেন, ‘এখানে ভোট হচ্ছে না, কেননা কমিশনের বৈধতা নেই। যারা আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছে তাদের বিচার করতে হবে। এখন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীসহ সাধারণ আইনজীবীদের ডেকে মতামত দিয়ে নতুন করে ভোট গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে আমাদের আন্দোলন চলবে।’

সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘তাঁরা মনসুরুল হককে অপমান করে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। তাঁদের বাধা দেওয়ায় পুলিশ দিয়ে আমাদের নির্যাতন করে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছেন। এ অবস্থায় সবার মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন সাবকমিটি গঠন করে নতুন নির্বাচন করতে হবে।’

তবে সমিতির বর্তমান সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেছেন, মাহবুব উদ্দিন খোকনের নেতৃত্বে রুহুল কুদ্দুস ও তাঁদের বাহিনী মঙ্গলবার রাতে সমিতির সম্মেলনকক্ষে ঢুকে ভাঙচুর ও কিছু ব্যালট পেপার ছিনতাই করে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সকালে তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে ভোট গ্রহণ শুরু করতে প্রায় দুই ঘণ্টা দেরি হয়। যখন শান্তিপূর্ণভাবে ভোট চলছিল, তখন তারা প্যান্ডেল ভাঙচুর ও ভোট দিতে আসা আইনজীবীদের ওপর আক্রমণ করে। এতে অনেক আইনজীবী আহত হন।

প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ

পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিষয়টি গতকাল দুপুরে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সঙ্গে তাঁর চেম্বারে গিয়ে দেখা করে বিষয়টি অবহিত করে ল রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি আশুতোষ সরকারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, তাঁরা মর্মাহত। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা

এ ছাড়া পৃথক বিবৃতিতে সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও পুলিশের ভূমিকার নিন্দা জানিয়েছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি), বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক সমিতি।