শতকোটি টাকার তালগাছ কৌশল ব্যর্থ, আসছে হাজার কোটির বজ্রনিরোধক দণ্ড

  • আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৬২ কোটি টাকার ‘সেন্সর’ কাজ করে না।

  • এলজিইডির প্রকল্পে বসানো হচ্ছে বজ্রনিরোধক দণ্ড।

  • একই প্রকল্প নিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়ও।

সারা দেশে ৪০ লাখ তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, এতে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু কমবে। প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ও হয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা যায়, তালগাছ কৌশল ব্যর্থ হয়েছে।

বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এবার ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়ে আসছে। এর আওতায় বসানো হবে বজ্রনিরোধক দণ্ড (লাইটনিং অ্যারেস্টার), বানানো হবে আশ্রয়কেন্দ্র।

অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল ব্যয়ের এই প্রকল্প আসলে টাকার অপচয়। আশ্রয়কেন্দ্র বানিয়ে বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকানো যাবে না। দরকার সচেতনতা। সেটা নিশ্চিতে অল্প ব্যয় করলেই হয়।

বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর যখন ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প অনুমোদনের চেষ্টা করছে, তখন কৃষি মন্ত্রণালয়ও একই কাজে আরেকটি প্রকল্প নিচ্ছে। ব্যয় ২৩১ কোটি টাকা। ওদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) একটি প্রকল্পে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের একাংশ দিয়ে বজ্রনিরোধক দণ্ড বসাচ্ছে।

তালগাছ লাগাতে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ের সুফল নেই। বজ্রনিরোধক দণ্ড বসাতে ১,৩২১ কোটি টাকার প্রকল্প।
বজ্রপাত

এর আগে আবহাওয়া অধিদপ্তর ২০১৮ সালে বজ্রপাতের আগাম সংকেত দিতে ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে আটটি জায়গায় লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর (সংকেতব্যবস্থা) বসিয়েছিল, যা এখন কাজে লাগছে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকাতে যেসব অবৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তা দেখে আমি হতাশ। এ ধরনের চিন্তা কীভাবে আসে?’

এ ধরনের প্রকল্প সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয় উল্লেখ করে সাইফুল ইসলাম বলেন, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানোর একমাত্র কার্যকর উপায় সচেতনতা বাড়ানো।

টিআর প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ৪০ লাখ তালগাছের চারা লাগানোর উদ্যোগ নেয়। দুই বছর না যেতেই দেখা যায়, তালগাছের চারা কোথাও মরে গেছে, কোথাও চারা না লাগিয়ে টাকা নেওয়া হয়েছে।

নতুন প্রকল্পে ব্যয় ১৩২১ কোটি টাকা

বজ্রপাতকে ২০১৬ সালে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের হিসাবে, বজ্রপাতে বছরে গড়ে ২৪২ জন মারা যান।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর যে ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার প্রকল্প নিচ্ছে, তার আওতায় দেশের ১৫টি জেলায় ৬ হাজার ৭৯৩টি বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো ও ৩ হাজার ৩৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। দণ্ড বসাতে ব্যয় হবে ৭৩২ কোটি টাকা, আশ্রয়কেন্দ্রে খরচ হবে ৪০৫ কোটি টাকা। বাকি টাকা প্রকল্পের অন্যান্য কাজের জন্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জে বাস্তবায়িত হবে এ প্রকল্প। কারণ, ওই সব জেলায় বজ্রপাতে মৃত্যু বেশি।

বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকাতে যেসব অবৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তা দেখে আমি হতাশ। এ ধরনের চিন্তা কীভাবে আসে?
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক সাইফুল ইসলাম

 ‘দেশের অধিক বজ্রপাতপ্রবণ ১৫ জেলায় বজ্রপাতের ফলে প্রাণহানি রোধে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ’ শিরোনামের প্রকল্পটি গত জুন মাসে প্রথমবার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছিল। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, টাকার অভাব ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের যৌক্তিকতা খুঁজে না পেয়ে প্রকল্পটি ফেরত পাঠানো হয়। অবশ্য নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একই প্রকল্প আবার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো হয়েছে। সেখানে মৃত্যু কমেছে। এ কারণেই দেশের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকার জন্য প্রকল্পটি নেওয়া হয়। তিনি বলেন, বজ্রপাতে প্রাণহানি রোধে নির্মাণ করা আশ্রয়কেন্দ্র অন্য আশ্রয়কেন্দ্রের মতো হবে না। এগুলো ছোট ছোট স্থাপনা হবে। স্থাপনাগুলো নির্মাণের পর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা একটি প্রকল্প নেওয়া হবে।

প্রকল্প প্রস্তাবে ২৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭ জেলায় ১৬টি বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো, মুঠোফোন অ্যাপ তৈরিসহ নানা কাজের কথা বলা হয়েছে।

অবশ্য পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকাতে নির্মাণ করা আশ্রয়কেন্দ্র বছরের বড় সময় খালি পড়ে থাকবে। এতে স্থাপনাগুলো টিকবে না। প্রশ্ন উঠেছে, বড় প্রশ্ন সরকারের একাধিক সংস্থা একই কাজে অর্থ ব্যয় করছে কেন?

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনার মতো এলাকায় বজ্রনিরোধক দণ্ড বসিয়ে কিছুটা সুফল পাওয়া যেতে পারে। এ জন্য পরীক্ষামূলক একটি ছোট প্রকল্প নেওয়া যায়। স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া সেটার সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, বজ্রনিরোধক দণ্ডের তামার তার চুরি যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তিনি বলেন, নেপালে প্রাণহানি কমাতে বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো হয়েছে। প্রথম দিকে ব্যাপক সমস্যা হয়েছিল। পরে তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের যুক্ত করে সফলতা পায়।

আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণকে অপচয় উল্লেখ করে গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, কৃষকেরা মাঠে কাজ করতে যান মেঘ-বৃষ্টির মধ্যেই। মেঘ দেখে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে তাঁরা বসে থাকবেন, এটা বাস্তবসম্মত চিন্তা নয়। বজ্রপাতে আহত কৃষকদের চিকিৎসার কোনো ‘প্রটোকল’ (নির্দেশিকা) নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিনিয়োগ হওয়া উচিত ‘প্রটোকল’ তৈরিতে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ২০২২ সালের ১১ মে সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, তালগাছ লাগানোর কার্যক্রমটি বাতিল হয়েছে। একটি তালগাছ বড় হতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৪০ বছর। এত সময় ধরে অপেক্ষার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

২০১৭ সালে তালগাছ, ২০১৮ সালে ‘সেন্সর’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ২০১৭ সালে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ৪০ লাখ তালগাছের চারা লাগানোর উদ্যোগ নেয়। দুই বছর না যেতেই দেখা যায়, তালগাছের চারা কোথাও মরে গেছে, কোথাও চারা না লাগিয়ে টাকা নেওয়া হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের হিসাবে, তালগাছ লাগাতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১০০ কোটি টাকা। মানুষের মৃত্যু কমেনি। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া। কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষাও হয়নি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ২০২২ সালের ১১ মে সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, তালগাছ লাগানোর কার্যক্রমটি বাতিল হয়েছে। একটি তালগাছ বড় হতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৪০ বছর। এত সময় ধরে অপেক্ষার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এখন তালগাছ লাগানোর কৌশলটি সঠিক ছিল না বলে স্বীকার করছে। সংস্থাটির মহাপরিচালক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকাতে তালগাছ সফল—এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। তাই তালগাছ বাদ দিয়ে বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁর জানামতে, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে এটি কার্যকর।

এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর বজ্রপাতের আগাম সংকেত জানাতে ২০১৮ সালে ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের আটটি জায়গায় ‘লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর’ বসানোর উদ্যোগ নেয়। উদ্দেশ্য ছিল, বজ্রপাতের ১০ থেকে ৩০ মিনিট আগে সংকেত দেওয়া।

প্রকল্পটির পরিচালক ছিলেন মজিদুল ইসলাম, যিনি এখন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিকল্পনা মহা শাখার আবহাওয়াবিদ। তিনি ১১ ডিসেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, জনবলের অভাবে সেন্সরগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও সেন্সর বন্ধ আছে। কোথাও সংযোগের, কোথাও বিদ্যুতের, কোথাও ইন্টারনেটের সমস্যা। এসব কারণে সেন্সর থেকে তথ্য পাওয়া যায় না।

দণ্ড বসাচ্ছে অন্যরাও

এলজিইডি এ বছরের জানুয়ারিতে রেসিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর অ্যাডাপটেশন অ্যান্ড ভালনারবিলিটি রিডাকশন (রিভার) শিরোনামে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়। প্রকল্পের একটি অংশে দেশের ১৪টি জেলায় ১ হাজার ৪০০টি বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানোর কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি জেলা রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের প্রস্তাবিত প্রকল্পে।

‘হাওরাঞ্চলে কৃষকদের জীবনের সুরক্ষায় বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন’ শিরোনামে একটি প্রকল্প নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি এখনো পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়নি। প্রকল্প প্রস্তাবে ২৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭ জেলায় ১৬টি বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো, মুঠোফোন অ্যাপ তৈরিসহ নানা কাজের কথা বলা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা একাধিক সংস্থার একই রকম প্রকল্পের বিষয়ে বলেন, প্রকল্প নিলে বিদেশ সফরে যাওয়া যায়, অনিয়ম করা যায়। একই কাজে একাধিক প্রকল্প নেওয়া মানে টাকা নষ্ট।